نحمدہ و نصلي علي رسوله الکریم اما بعد
আল্লাহ তাআলার ইবাদত করতে গেলে সর্বপ্রথম কাজ হল পবিত্র হওয়া, বড় নাপাক থেকে পবিত্র হতে হলে গোসল করতে হয়, আর ছোট নাপাক থেকে পবিত্র হতে হলে ওযু করতে হয়, আমরা তো অজু করি, গোসল করি, কিন্তু সুন্নত তরিকায় না হওয়ার কারণে ওই গোসলও পরিপূর্ণ হয় না অজুও পরিপূর্ণ হয় না৷ অজু গোসল বাহ্যিক দৃষ্টিতে হয়ে যাওয়া এক জিনিস, আর আল্লাহ তাআলার কাছে পরিপূর্ণ গোসল রূপে উপস্থাপন হওয়া ভিন্ন জিনিস৷ বাহ্যিক দৃষ্টিতে তো কত কিছুই আমরা করছি, হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওই আমালগুলো আল্লাহ তাআলার কাছে কবুল হতে হলে, পরিপূর্ণ হতে হলে, সেগুলোর মধ্যে অবশ্যই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নতের অনুসরণ করতে হবে, তাই এখানে অজু ও গোসলের সুন্নত সমূহ আলোচনা করা হল :
উযুর সুন্নাতসমূহ
১. উযুর নিয়ত করা অর্থাত উযুকারী মনে মনে এই নিয়ত করবে যে, পবিত্রতা অর্জন করা ও নামায জায়েয হওয়ার জন্য আমি উযু করছি। (সূরা বায়্যিনাহ, ৫/ বুখারী শরীফ, হাঃ নং ৬৬৮৯)
২. বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়ে উযু আরম্ভ করা। হাদীসে পাকে আছে, বিসমিল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহ পড়ে উযু করলে যতক্ষণ ঐ উযু থাকবে, ফেরেশতাগণ তার নামে ততক্ষণ অনবরত সাওয়াব লিখতে থাকবে, যদিও সে কোন মুবাহ কাজে লিপ্ত থাকে। (নাসায়ী শরীফ, হাঃ নং ৭৮/ তাবারানী সাগীর, ১ : ৭৩)
৩. উভয় হাত পৃথকভাবে কব্জিসহ তিনবার ধোয়া। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ১৫৯)
৪. মিস্ওয়াক করা। যদি মিস্ওয়াক না থাকে তাহলে আঙ্গুল দ্বারা দাঁত মাজা মিস্ওয়াক অর্ধ হাতের চেয়ে বেশি লম্বা না হওয়া এবং গাছের ডাল হওয়া মুস্তাহাব। (মুসনাদে আহমাদ, হাঃ নং ৯২১৬, ১৩৯, ৩৯৯০/ তিরমিযী, হাঃ নং ২৩/ বাইহাকী, হাঃ নং ১৭৪)
৫. তিনবার কুলি করা। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ১৮৫)
৬. তিনবার নাকে পানি দেয়া এবং নাক সাফ করা। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাঃ নং ১০৭৭)
৭. ততসঙ্গে প্রতিবারই নাক ঝাড়া। (মুসলিম শরীফ, হাঃ নং ২৩৬)
৮. প্রত্যেক অঙ্গকে পূর্ণভাবে তিনবার করে ধোয়া। এর জন্য তিনবারের বেশি পানি নিতে হলে নিবে। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ১৫৯)
৯. দুই হাতে মুখ ধোয়া এবং মুখমণ্ডল ধোয়ার সময় দাড়ি খিলাল করা। (তিরমিযী, হাঃ নং ৩১)
১০. হাত ও পা ধোয়ার সময় আঙ্গুলসমূহ খিলাল করা। (তিরমিযী, হাঃ নং ৩৮)
১১. একবার সম্পূর্ণ মাথা মাসাহ্ করা। (তিরমিযী, হাঃ নং ৩৪)
১২. উভয় কান মাসহ করা। উল্লেখ্য, কানের ছিদ্রের মধ্যে কনিষ্ঠ আঙ্গুল ঢুকিয়ে এবং ভিতর দিকে অবশিষ্ট অংশে শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা মাসাহ করা। (তিরমিযী, হাঃ নং ৩৩/ আবু দাউদ, হাঃ নং ১৩৫)
১৩. উযুর অঙ্গসমূহ হাত দ্বারা ঘষে-মেজে ধোয়া। (মুস্তাদরাক, হাঃ নং ৫৭৬/ সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাঃ নং ১১৮)
১৪. এক অঙ্গ ধোয়ার পর অন্য অঙ্গ ধৌত করতে বিলম্ব না করা। (মুসলিম, হাঃ নং ২৪৩/ আবু দাউদ, হাঃ নং ১৭৩)
১৫. তরতীবের সাথে উযু করা। অর্থাত উযুর অঙ্গসমূহ ধোয়ার সময় ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। (আবু দাউদ, হাঃ নং ১৩৭)
১৬. ডান দিকের অঙ্গ আগে ধোয়া। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ১৬৮)
১৭. শীত অথবা অন্য কোন কারণে যখন উযু করতে ইচ্ছে না হয়, তখনও উযুর অঙ্গসমূহ উত্তমরূপে ধুয়ে উযু করা। (তিরমিযী, হাঃ নং ৫১/ মুসলিম, হাঃ নং ২৫১)
১৮. উযুর মধ্যে নিম্নোক্ত দু‘আটি পড়া : ْاَللّٰهُمَّ اغْفِرْلِىْ ذَنْبِىْ وَ وَسِّعْ لِىْ فِىْ دَارِى وَ بَارِكْ لِىْ فِىْ رِزْقِىْ (আমালুল্য়াওমি ওয়াল লাইলি লি ইবনিসসুন্নী, হাঃ নং ২৮)
এবং উযু শেষ করে কালিমায়ে শাহাদাত পড়া। (মুসলিম শরীফ, হাঃ নং ২৩৪)
অতঃপর এ দু‘আ পড়া : َاَللّٰهُمَّ اجْعَلْنِىْ مِن التَّوَّابِيْنَ وَ اجْعَلْنِىْ مِنَ الْمُتَطَهِّرِيْنَ وَ اجْعَلْنِيْ مِنَ الَّذِيْنَ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَ لَا هُمْ يَحْزَنُوْنْ
(তিরমিযী, হাঃ নং ৫৫)
উল্লেখ্য, গোসল এবং তায়াম্মুমের শুরু ও শেষে উযুতে বর্ণিত দু‘আ সমূহ পড়বে।
বি.দ্র. শুধু এ সব বর্ণনা পড়ার দ্বারা সুন্নাত তরীকায় উযু করা সম্ভব নয়, এ জন্য কোন হাক্কানী আলেম থেকে সব বিষয়গুলো চাক্ষুষভাবে দেখে নিবে। আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হযরত জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে সকল বিষয় চাক্ষুষভাবে দেখিয়ে শিক্ষা দিয়েছেন।
(তিরমিযী, হাঃ নং ১৪৯)
গোসলের সুন্নাতসমূহ
১. ফরয গোসলের পূর্বে ইস্তিঞ্জা অর্থাত পেশাব করা। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাঃ নং ১০২০)
২. শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়া। (মুসনাদে আহমাদ, হাঃ নং ১২৬৯৪)
৩. পৃথকভাবে উভয় হাত কব্জিসহ ধোয়া। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ২৪৮)
৪. শরীর বা কাপড়ের কোন স্থানে নাপাকী লেগে থাকলে প্রথমে তা তিনবার ধুয়ে পবিত্র করে নেয়া।
(মুসলিম শরীফ, হাঃ নং ৩২১)
৫. নাপাকী লেগে থাকলে বা না লেগে থাকলে সর্ব অবস্থায় গুপ্তাঙ্গ ধৌত করা। এরপর উভয় হাত ভালভাবে ধুয়ে নেয়া। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ২৪৯)
৬. সুন্নাত তরীকায় পূর্ণ উযু করা। তবে গোসলের স্থানে পানি জমে থাকলে, গোসল শেষ করে পা ধৌত করবে। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ২৬০)
৭. প্রথমে মাথায় পানি ঢালা। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ২৫৬)
৮. এরপর ডান কাঁধে। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ২৫৪)
৯. এরপর বাম কাঁধে। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ২৫৪)
১০. অতঃপর অবশিষ্ট শরীর ভিজানো। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ২৭৪)
১১. সমস্ত শরীরে এমনভাবে তিনবার পানি পৌঁছানো, যেন একটি পশমের গোড়াও শুষ্ক না থাকে।
(আবু দাউদ, হাঃ নং ২৪৯/ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাঃ নং ৮১৩)
তবে নদী-পুকুর ইত্যাদিতে গোসল করলে কিছুক্ষণ ডুব দিয়ে থাকলেই তিন বার পানি ঢালার সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। (আবু দাউদ, হাঃ নং ২৪৯/ মুসান্নাফে ইবনে আবী মাইবা, হাঃ নং ৮১৩)
১২. সমস্ত শরীর হাত দ্বারা ঘষে-মেজে ধৌত করা। (তিরমিযী, হাঃ নং ১০৬)
ইস্তিঞ্জার সুন্নত সমূহ
১. মাথা ঢেকে রাখা। (বাইহাকী শরীফ, হাঃ নং ৪৫৬)
২. জুতা-সেন্ডেল পরিধান করে যাওয়া। (তাবাকাতে ইবনে সাআদ’, ১৮৫/ কানযুল উম্মাল, হাঃ নং-১৭৮৭২)
৩. পায়খানায় প্রবেশের পূর্বে এই দু‘আ পড়া : ِبِسْمِ اللّٰهِ اَللّٰهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُبِكَ مِنَ الْخُبْثِ وَ الْخَبَائِثِ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হাঃ নং ৫)
৪. দু‘আ পড়ার পর আগে বাম পা ঢুকানো। (আবু দাউদ, হাঃ নং ৩২)
৫. কিবলার দিকে মুখ বা পিঠ দিয়ে না বসা। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ১৪৪)
৬. যথাসম্ভব বসার নিকটবর্তী হয়ে ছতর খোলা এবং বসা অবস্থায় পেশাব ও পায়খানা করা, দাঁড়িয়ে পেশাব না করা। (নাসায়ী শরীফ, হাঃ নং ২৯/ তিরমিযী শরীফ, হাঃ নং ১৪)
৭. পেশাব ও নাপাক পানির ছিঁটা হতে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বেঁচে থাকা। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ২১৮)
৮. পানি খরচ করার পূর্বে ঢিলা-কুলুখ (বা টয়লেট পেপার) ব্যবহার করা। (বাইহাকী, হাঃ নং ৫১৭)
৯. ঢিলা ও পানি খরচ করার সময় বাম হাত ব্যবহার করা। (বুখারী শরীফ, হাঃ নং ১৫৪)
১০. পেশাবের ফোঁটা আসা বন্ধ হওয়ার জন্য আড়ালে সামান্য চলাফেরা করা। (ইবনে মাজাহ শরীফ, হাঃ নং ৩২৬)
১১. যেখানে পেশাব ও পায়খানার জন্য নির্ধারিত কোন জায়গা নেই, সেখানে এমনভাবে বসা যেন ছতর নজরে না পড়ে। (আবু দাউদ হাঃ নং ২)
১২. পেশাবের জন্য নরম বা এমন স্থান তালাশ করা যেখান থেকে পেশাবের ছিঁটা শরীরে বা কাপড়ে না লাগে। (আবু দাউদ, হাঃ নং ৩)
১৩. ঢিলা-কুলুখ ব্যবহারের পর পানি ব্যবহার করা। (সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাঃ নং ৮৩)
১৪. ডান পা দিয়ে বের হওয়া। (আবু দাউদ, হাঃ নং ৩২)
১৫. বাইরে এসে এই দু‘আ পড়া : َغُفْرَانَك اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِىْ اَذْهَبَ عَنِّى الْاَذىٰ وَ عَافَانِىْ (আবু দাউদ, হাঃ নং ৩০ : ইবনে মাজাহ, হাঃ নং ৩০১)
৬ জিনিস নিয়ে ইস্তিঞ্জায় যাওয়া নিষেধঃ
১.আল্লাহ তালার নাম।
২. নবীগনের নাম।
৩. ফেরেশতাগনের নাম।
৪. কোরআনের আয়াত।
৫. হাদিসের টুকরা।
৬. দুআ কালাম লিখিত ও অঙ্কিত।
১০ জায়গায় ইস্তিঞ্জা করা নিষেধঃ
১.মানুষ চলাচলের রাস্তায়।
২.ছায়াদার ফলদার গাছের নিচে।
৩.উযু গোসলের স্থানে।
৪.গর্তের ভিতরে।
৫.গোরস্তানে।
(আবু দাউদ,১/৫)
৬.দাঁড়িয়ে বা হেঁটে।
(তিরমিযি, ১/৯)
৭.বিনা ওজরে পানিতে।
(তালীমুল ইসলাম-৩/১২)
৮.ঘরে বা বিছানায়।
৯. মসজিদের আঙ্গিনায় বা ঈদগাহে।
১০.জনসম্মুখে।
(তালীমুল ইসলাম ১/৪২)
১০ জিনিস দারা ইস্তিঞ্জার করা নিষেধঃ
১. হাড্ডি।
২. কয়লা।
৩. কাগজ।
৪. কাঁচ।
৫. গাছের কাচাপাতা।
৬. খাদ্যদ্রব্য।
৭. শুকনা গোবর।
৮. জমজমের পানি।
৯. ডানহাত দ্বারা।
১০. ব্যাবহৃত ঢিলা দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে উপরোক্ত সুন্নত সমূহের উপর পরিপূর্ণ ভাবে আমল করার তৌফিক দান করুন, আমিন৷