আরবী তারিখঃ এখন ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরি মুতাবিক ২৬ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রোজ শুক্রবার, সময় রাত ৪:৪০ মিনিট
এলানঃ-
১৪৪৫-১৪৪৬ হিজরী, ২০২৪-২০২৫ ইং এর মাসিক সুন্নতী ইজতেমা সমূহ
* ২৫ এপ্রিল ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ৩০-৩১ মে ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৭ জুন ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ২৫-২৬ জুলাই ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৯ আগষ্ট ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ২৬-২৭ সেপ্টেম্বর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৪ অক্টোবর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ২৮-২৯ নভেম্বর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৬ ডিসেম্বর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ৩০-৩১ জানুয়ারী ২৫ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৭ ফেব্রুয়ারী ২৫ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* মার্চ ২৫ ইং এজতেমা সালেকীনদের জন্য

দ্বীনী কাজে খশইয়ত ও হিকমতের প্রয়োজনীয়তা : ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ বসুন্ধরায় মাওলানা তাকী উসমানী দা. বা.

আলহামদুলিল্লাহ, বাংলাদেশে আমার আগমন এবারই প্রথম নয়। ১৯৫৮ ইং থেকে এদেশে আসা শুরু হয়েছে এবং এখনো চলছে। তখন আমার মুহতারাম আববাজান হযরত মাওলানা মুফতী শফী রাহ. তাশরীফ আনতেন। বড় বড় আকাবির তখন এখানে ছিলেন। হযরত মাওলানা আতহার আলী রাহ., হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ. প্রমুখ। মুহতারাম আববাজানের সঙ্গে একজন তালিবে ইলম হিসেবে আমিও আসতাম। তখন থেকে এ পর্যন্ত দশ-বারোবার এদেশে আসার সুযোগ হয়েছে। পাকিস্তান আমলেও এবং বাংলাদেশ হওয়ার পরও বার বার আসা হয়েছে। কিন্তু এবার বিশেষভাবে যে বিষয়টা অনুভব করছি এবং যার কারণে মনে অত্যন্ত খুশি অনুভূত হচ্ছে তা হল সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে ভালো দেখা যাচ্ছে এবং হযরত উলামায়ে কেরামের মধ্যে ইলমী ‘যাওক’ এবং তালীফ-তাসনীফের জযবা আগের চেয়ে অনেক বেশি নজরে পড়ছে। আলহামদুলিল্লাহ।

একসময় ছিল যখন বাংলা ভাষায় দ্বীনী বই-পত্র প্রায় অনুপস্থিত ছিল। হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ.-আল্লাহ তাঁকে জাযায়ে খায়ের দান করুন- বেহেশতী জেওরের বাংলা অনুবাদ করেছেন। এর দ্বারা এখানকার লোকেরা অনেক উপকৃত হয়েছে। কিন্তু তখন তা ছিল দুই একটি ঘটনা। এই অভিযোগ তখন ব্যাপক ছিল যে, উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে দ্বীনী বই-পত্র সরবরাহ করা হয় না। আলহামদুলিল্লাহ এবার দেখছি উলামায়ে কেরাম বিশেষত নবীন উলামায়ে কেরাম রচনা-সংকলন ও গবেষণার কাজে এগিয়ে চলেছেন। বিভিন্ন খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন এবং বড় বড় কিতাবের বাংলা অনুবাদ হচ্ছে। আগে এই অভিযোগও ব্যাপক ছিল যে, আমাদের আলেমদের বাংলা ভাষায় যথাযথ দক্ষতা নেই। যার কারণে বাংলাভাষীদের কাছে দ্বীনের পয়গাম পৌঁছাতে যথেষ্ট ত্রুটি হয়। আল্লাহ তাআলা যখনই কোনো জাতির কাছে নবী পাঠিয়েছেন তাকে সেই জাতির ভাষা দিয়েই পাঠিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, তরজমা : ‘আমি সকল নবীকেই তার জাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছি।’ তদ্রূপ যে জাতির কাছে নবী পাঠাতেন তিনি তাদের ভাষায় সর্বশ্রেষ্ঠ সুভাষী হিসাবে স্বীকৃত হতেন। আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মী ছিলেন, কিন্তু আরবী ভাষায় তাঁর দক্ষতা ও নিপূণতা এমন ছিল যে, মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকল আরব এ বিষয়ে একমত ছিল যে, আরবী ভাষায় তিনিই হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ সুভাষী। এ থেকে বোঝা যায় যে, যারা দ্বীনের কাজ করবে তাদের জন্য স্বজাতির ভাষায় বিশেষ পান্ডিত্য ও দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। এ বিষয়েও আগে অনেক অভিযোগ শোনা যেত। আলহামদুলিল্লাহ এবার দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে যে, প্রতিদিনই কোনো না কোনো কিতাব আমার হাতে আসছে, যা মাশাআল্লাহ এদেশের আলেমগণ বাংলাভাষায় লিখেছেন। আল্লাহ তাদের এ প্রেরণায় আরো বরকত ও উন্নতি দান করুন। আমীন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলহামদুলিল্লাহ এদিকে আলেমদের নজর পড়েছে। একজন আলেমর জন্য তার স্বজাতির ভাষায় পূর্ণ দক্ষতা থাকা খুবই জরুরি। যাতে তাদের মাঝে সহীহ শুদ্ধ ভাষায় দ্বীনের পয়গাম পৌঁছাতে পারেন। এখন আরো অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।

এটা দেখেও অনেক খুশি লাগছে যে, এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মাশাআল্লাহ তাহকীকের কাজ করছে। হাদীসের বিষয়েও হচ্ছে, ফিকহের বিষয়েও হচ্ছে। হাদীস ও ফিকহের তাখাসসুস বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এগুলোতে আরো বরকত ও উন্নতি দান করুন।আরো কিছু কথা আছে, যা প্রথমত আমি নিজেকেই বলছি তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে আপনাদের খেদমতে পেশ করতে চাচ্ছি।কথাগুলো হল, সকল ইলমী কাজ, চাই তা দরস-তাদরীসের কাজ হোক, ফতোয়ার কাজ হোক, তাহকীক-তাসনীফের কাজ হোক কিংবা অনুবাদের কাজ হোক সবই বড় মুবারক কাজ। কিন্তু তাতে নূর ও বরকত ততক্ষণ পর্যন্ত আসে না এবং তা দ্বারা কোনো ফায়দা ততক্ষণ পর্যন্ত হাসিল হয় না যতক্ষণ ইলমের মূল উপাদান খাশইয়াতুল্লাহ বা আল্লাহর ভয় পয়দা না হয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত নফসের পবিত্রতা অর্জিত হয় না ততক্ষণ পর্যন্ত তার কোনো ইলমী কাজে বরকত হয় না।

লক্ষ্য করে দেখুন, ইতিপূর্বে কত উলামা ফুকাহা ও মুহাদ্দিসীন অতীত হয়েছে। বড় বড় মুসান্নিফ অতীত হয়েছেন। কিন্তু বহু নামজাদা লেখক-গবেষকের রচনা ও গবেষণা বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। কেউ তা থেকে উপকৃত হয়নি। পক্ষান্তরে যখনই কোনো কিতাব আল্লাহর কাছে মকবুল হয়েছে তখন তা মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে এবং মানুষের অনেক উপকার করেছে। মকবুলিয়ত আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় এবং আল্লাহর কাছেই হয়। আমি মুহতারাম আববাজান রাহ.-এর কাছে শুনেছি যখন ইমাম মালেক রাহ. মুয়াত্তা কিতাব সংকলন করলেন এবং মানুষের কাছেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত হতে লাগল তখন অনেকেই কিতাব লিখে মুয়াত্তা নাম রাখলেন। মুয়াত্তা নামে অনেক কিতাব রচিত হয়ে গেল। কেউ ইমাম মালেক রাহ.কে বলল, হযরত!আপনি যে মুয়াত্তা সংকলন করেছেন এখন তো অনেকেই তা নকল করা শুরু করেছে। মুয়াত্তা নামে অনেক কিতাব লেখা হয়েছে। ইমাম মালেক রাহ. বললেন, অসুবিধা কী? লিখতে দাও। তারপর যে বাক্যটি বললেন তা হল, ‘মা কানা লিল্লাহি ইয়াবকা’ অর্থাৎ যে কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হবে তা বাকি থাকবে। আর যদি কেউ নামের জন্য, লোক দেখানোর জন্য কোনো কাজ করবে তবে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। এমনকি তা কেউ জানবেও না। বাস্তবও তাই। এখন ঐ সব মুয়াত্তার কোনো নাম নিশানাও নেই। কিন্তু ইমাম মালেক রাহ.-এর মুয়াত্তা সুনাম সুখ্যাতির সঙ্গে টিকে আছে। আরেক মুয়াত্তা আছে ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর, এটিও সেই মুয়াত্তারই অন্য রেওয়ায়েত।

আসল বিষয় হল যে কাজই করা হোক তা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যে হতে হবে। সুনাম-সুখ্যাতির জন্য নয়। আমার নিজের একটি ঘটনা শোনাচ্ছি, যার দ্বারা আমার অনেক উপকার হয়েছে। আপনাদের জানা আছে যে, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেছিল এবং সামরিক শাসন চালু হয়েছিল। তখন সে সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় মুসলিম পারিবারিক আইন জারি করল। আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন যে, সেই পারিবারিক আইন ছিল শরীয়ত পরিপন্থী। সকল উলামায়ে কেরাম তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। আলোচনা করেছেন, বিবৃতি দিয়েছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। তখন এক লোক সরকারের এই পারিবারিক আইনের পক্ষে একটি পুস্তক রচনা করে। যাতে কুরআন সুন্নাহর অপব্যাখ্যা করে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে,আইয়ুব খানের জারি করা পারিবারিক আইন কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী নয়।

মুহতারাম আববাজান রাহ. আমাকে তার জবাব লেখার হুকুম দিলেন। তখন মাত্র দাওরায়ে হাদীস থেকে ফারিগ হয়েছি। জওয়ানির প্রথম অবস্থা। কলম জোশে পূর্ণ। প্রতিপক্ষকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ করার প্রবণতা খুব তীব্র। ফলে এমন এমন আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করলাম যে, এভাবে পূর্ণ দুই আড়াইশ পৃষ্ঠার কিতাব লিখলাম। যাতে ওই ব্যক্তিকে খুব আক্রমণ-উপহাস করা হল যে পারিবারিক আইনের সমর্থন করেছিল। তবে আমার নিয়ম ছিল যে কোনো লেখা আববাজানকে পড়ে শোনানো বা দেখানো ছাড়া প্রকাশ করতাম না।এই কিতাব লিখেও আববাজানকে পড়ে শোনালাম। আববাজান পুরো কিতাব শুনে বললেন, বাবা! তুমি তো সাহিত্যের বিচারে খুব সুন্দর কিতাব লিখেছ। এর সাহিত্যমান অনেক উন্নত। কিন্তু আমাকে বল, তুমি কি এটা এজন্য লিখেছ যে, যারা আগে থেকে তোমার পক্ষে আছে তারা বাহবা দিবে এবং বলবে, বাহ! কত চমৎকার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছে! কি শক্তিশালী কায়দায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হয়েছে। যদি তাদের এমন প্রশংসা লাভের জন্য লিখে থাক তাহলে তোমার এ কিতাব খুবই সফল একটি কিতাব। তোমার পক্ষের লোকেরা এই কিতাব পড়লে পঞ্চমুখে তোমার প্রশংসা করবে।কিন্তু উদ্দেশ্য যদি এই হয় যে, যারা ওই কিতাব পড়ে গোমরাহ হয়েছে তাদেরকে পুনরায় চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করা এবং তাদেরকে সঠিক পথে আনার চেষ্ট করা তাহলে তোমার এই রচনার কানাকড়িও মূল্য নেই। কারণ তুমি শক্ত ভাষায় আক্রমণ করে ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করে প্রথমেই তাদেরকে বীতশ্রদ্ধ করে দিয়েছ। প্রথমেই তারা এটা ভাববে যে, এতো আমাদের বিপক্ষের কেউ লিখেছে। আমাদের সঙ্গে দুশমনি করে লিখেছে। তাই এই কিতাব থেকে তারা কিছু গ্রহণ করতে পারবে না। সুতরাং এই কিতাব লেখার উদ্দেশ্য যদি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা এবং মানুষের হেদায়েতের পথ সুগম করা হয়ে থাকে তাহলে তোমার এই কিতাবের এক পয়সাও দাম নেই। তারপর বললেন, দেখ, আল্লাহ যখন হযরত মূসা আ. এবং হযরত হারূন আ.কে ফেরাউনের কাছে পাঠালেন তখন তাদেরকে বলেছিলেন, তরজমা : ‘ফেরাউনের সঙ্গে আপনারা নরম ভাষায় কথা বলবেন। হতে পারে সে নসীহত গ্রহণ করবে। হতে পারে তার অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হবে।’ অথচ আল্লাহ আগে থেকেই জানতেন সে নসীহত গ্রহণ করবে না। তার তাকদীরে হেদায়েত নেই।

হযরত মূসা আ. ও হারূন আ.কে বললেন, তোমাদের চিন্তা করতে হবে তোমাদের মাথায় এ কথা থাকতে হবে যে, হতে পারে সে সত্যের আহবানে সাড়া দিবে। হতে পারে সে নসীহত গ্রহণ করবে। হতে পারে তার অন্তরে আল্লার ভয় ঢুকবে।তুমি মূসা. এর চেয়ে বড় মুসলিহ দাঈ হতে পার না আর তোমার প্রতিপক্ষও ফেরাউনের চেয়ে বেশি গোমরাহ হতে পারে না। সুতরাং তাঁদেরকেই যখন নরম ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছেতাহলে আমি আর তুমি কোন কাতারে শুমার হব? সুতরাং যদি কারো হেদায়েতই উদ্দেশ্য হয় তাহলে দাওয়াতের ওই পয়গাম্বরী পন্থা অবলম্বন করা ছাড়া আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন না।আববাজান যখন এই কথা বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, এমনভাবে তা অন্তরে স্থান করে নিল যে, সেই দুই আড়াইশ পৃষ্ঠার কিতাব আমি আবার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লিখলাম। যা এখন ‘হামারে আয়েলী মাসায়েল’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। পুরো কিতাব পুনরায় লিখেছি এবং তাতে আক্রমণাত্মক ও ব্যাঙ্গাত্মক যেসব কথাবার্তা ছিল তা সম্পূর্ণ বাদ দিয়েছি। তারপর আববাজান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বললেন, আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। বললেন, যখনই কোনো কথা যবানে বা কলমে বের করবে তার আগে চিন্তা করে নিবে যে, এ কথা আমাকে আদালতের কাঠগড়ায় প্রমাণ করতে হবে। যদি দেখ একথা আদালতে প্রমাণ করা যাবে না তাহলে তা যবানেও আনবে না, কলমেও লিখবে না। কারণ এমন সময় আসতেও পারে যখন ওই কথা তোমাকে আদালতে প্রমাণ করতে হবে।

আর যদি দুনিয়ার আদালতে প্রমাণ করা নাও লাগে তাহলে একসময় তো অবশ্যই আসবে যখন আহকামুল হাকিমীনের আদালত কায়েম হবে এবং সেখানে অবশ্যই তোমাকে জবাবদিহী করতে হবে। যে কথাই তোমার যবান থেকে বের হচ্ছে তা সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। তাই যে কথাই বল চিন্তা করে বল।এটি এমন একটি বাক্য ছিল, যার পর থেকে আলহামদুলিল্লাহ যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, যেন কলম থেকে এমন কোনো কথা বের না হয় যা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তারপর আমি ঈসাইদের বিরুদ্ধে লিখেছি। কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে লিখেছি, রাফেযীদের বিরুদ্ধে লিখেছি, বেদআতীদের বিরুদ্ধে লিখেছি, গায়রে মুকাল্লিদ এবং মুতাজাদ্দিদীনদের বিরুদ্ধে লিখেছি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা মেহেরবানী করে আববাজানের ঐ কথার উপর আমল করার তাওফীক দান করেছেন। যার ফল এই হয়েছে যে, আমার কিতাব ‘ঈসাইয়াত কেয়া হ্যায়?’ পড়ে যা ঈসাইদের বিরুদ্ধে লিখা হয়েছে- আলহামদুলিল্লাহ বহু ঈসাই ইসলাম গ্রহণ করেছে। আববাজানের এই নসীহতের উপর আমল না করলে হয়তো এ পরিমাণ ফায়দা হতো না।

তো আসল দেখার বিষয় হল, সুখ্যাতি বা মানুষের প্রশংসা লাভ করা উদ্দেশ্য না আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা উদ্দেশ্য? যতক্ষণ এই চিন্তা না আসে ততক্ষণ ইলমে বরকত হয় না। এটা ছাড়া মানুষ যত তাহকীকী কাজই করুক না কেন তাতে বরকত হয় না।মুহতারাম আববাজান আরেকটি কথা বলতেন। বলতেন, দেখ আমাদের উর্দূ ভাষায় দুইজন কবি আছেন একজন ইকবাল আরেকজন আকবর ইলাহাবাদী। চিন্তা ধারার দিক থেকে আকবর ইলাহাবাদী ইকবাল অপেক্ষা উলামায়ে কেরামের চিন্তা-চেতনার অনেক বেশি কাছের। কিন্তু ইকবালের কথায় যত উপকার হয়েছে আকবর ইলাহাবাদীর কথায় তা হয়নি। কারণ আকবর ইলাহাবাদী যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল তা ছিল বিদ্রুপাত্মক। তিনি ব্যাঙ্গ-উপহাস করে কথা বলতেন, পক্ষান্তরে ইকবাল এই পদ্ধতি অবলম্বন করেননি। ফলে আল্লাহ তাআলা আকবর ইলাহাবাদী অপেক্ষা ইকবালের কথায় মানুষকে বেশি উপকৃত করেছেন। তো পয়গাম্বরানা দাওয়াতের পদ্ধতি হল দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকামিতার সঙ্গে দাওয়াত দিবে। প্রতিপক্ষ যদি তোমাকে গালিও দেয় তবুও তুমি তার প্রতিউত্তরে গালি দিবে না।(আববাজান) হযরত শাহ ইসমাইল শহীদ রাহ.-এর উদাহরণ দিতেন। তিনি এক বড় মাহফিলে ওয়াজ করছিলেন। অনেক বড় জমায়েত ছিল। শুনেছি, হযরতের ওয়াজ নাকি ঘন্টার পর ঘন্টা চলতে থাকত। তো ওয়াজের মাঝেই একজন দাড়িয়ে বলল, হযরত আমরা শুনেছি, আপনি নাকি হারামযাদা? (নাউযুবিল্লাহ)।

দেখুন, সে মাহফিলে দাড়িয়ে জনসমক্ষে কীভাবে গালি দিচ্ছে! আববাজান রাহ. বলতেন, অন্য কেউ হলে বলত, তুই হারামযাদা, তোর বাপ হারামযাদা, তোর দাদা হারামযাদা। কিন্তু হযরত শাহ ইসমাইল শহীদ রাহ. এটাকে একটা ঘটনা বানিয়ে দিলেন। বললেন, ভাই আপনি ভুল শুনেছেন। আমার আম্মাজানের বিয়ের সাক্ষী তো দিল্লীতে এখনও জীবিত আছেন। তিনি এটাকে একটা সাধারণ ঘটনা এবং অভিযোগ ধরে নিয়ে শান্তভাবে তার জবাব দিলেন। ফলাফল এই হয়েছে যে, তাঁর ওয়াজে আল্লাহ এমন প্রভাব দান করেছেন যে, এক এক ওয়াজে শত শত মানুষ তাঁর হাতে তওবা করত।হযরত থানভী রাহ.কে একজায়গায় ওয়াজের জন্য দাওয়াত করা হল। তিনি সেখানে তাশরীফ নিয়ে গেলেন। ওয়াজের আগেই একটি চিরকুট আসল। তাতে লিখিত ছিল, মাওলানা! আমরা শুনেছি, আপনি কাফের! কারণ মৌলভী আহমদ রেজাখান তখন এই ফতোয়া দিয়ে রেখেছিল। দ্বিতীয় কথা হল, আমরা শুনেছি, আপনি নাকি জোলা? তৃতীয় কথা হল, আপনি এই মজলিসে এমন কোনো কথা বলবেন না যাতে দেওবন্দী ও বেরেলভী উলামাদের মতপার্থক্য আছে। অন্যথায় আমরা আপনার কথা শুনব না।

এই চিরকুট পাওয়ার পর হযরত ওয়াজের জন্য তাশরীফ নিয়ে গেলেন। খোতবা পড়ার পর প্রথম কথা বললেন, ভাই! আমার কাছে একটি চিরকুট এসেছে, তাতে লেখা হয়েছে তুমি কাফের। দ্বিতীয় কথা হল, তুমি জোলা। তৃতীয় কথা হল এখানে মতপার্থক্যপূর্ণ কোনো কথা বলবে না। এরপর হযরত বললেন, প্রথম বিষয়ে আমার কথা হল, পিছনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে কোনো লাভ নেই। সুতরাং আমি কাফের ছিলাম না মুসলমান ছিলাম এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু আপনাদের জানা আছে যে, ইসলামে এমন একটি কালিমা আছে যা সত্তর বছরের কাফেরও যদি পড়ে তবে সে মুসলমান হয়ে যায়। কালিমাটি হল আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ তাই তোমরা পিছনের কথা বাদ দাও। এখন আমি তোমাদের সামনে কালিমা পড়ছি।

…দ্বিতীয় কথা আপনি লিখেছেন আমি জোলা। তো ভাই আমি তো এখানে কোনো বিয়ে শাদী বা আত্মীয়তার প্রস্তাব নিয়ে আসিনি। আত্মীয়তার প্রশ্ন থাকলে বংশপরিচয়ের যাচাই বাছাই করার প্রয়োজন ছিল। সুতরাং যদি ধরেও নেওয়া হয় আমি জোলা তাতে এমন কি যায় আসে।তৃতীয় কথা বলা হয়েছে মতবিরোধপূর্ণ কোনো বিষয় যেন আলোচনা না করি। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হল আমি তো এখানে নিজ থেকে বয়ান করার জন্য আসিনি আমাকে দাওয়াত করা হয়েছে। তাদের দাওয়াতের ভিত্তিতেই আমি এখানে এসেছি। যদি আপনাদের একজনও দাড়িয়ে একথা বলেন যে, আপনার ওয়াজ আমরা শুনব না, তাহলে আমি চলে যাব। আমার ওয়াজ করার কোনো শখ নেই। আমি পেশাদার কোনো ওয়ায়েজ নই। বাকি থাকল মতবিরোধপূর্ণ বিষয় আলোচনা না করা তো এ জাতীয় বিষয় আলোচনা করার অভ্যাস নেই। আমি দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলোই আলোচনা করে থাকি। তবে কথার প্রসঙ্গে কোনো মতবিরোধপূর্ণ বিষয় এসে গেলে তা এড়িয়ে যাই না। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে প্রকৃত সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করি। তাই এখনই আমি আপনাদেরকে ওয়াদা দিতে পরব না যে, ইখতেলাফী বিষয় আলোচনা করব কি করব না।

আমি তো সাধারণ কথাগুলো আলোচনা করব। কিন্তু তার মাঝে যদি কোনো ইখতেলাফী বিষয় এসে যায় তাহলে তা অবশ্যই আলোচনা করব। এখন আপনারা সবাই বলুন, আপনাদের কোনো একজনও যদি দাড়িয়ে বলেন যে, আমরা আপনার ওয়াজ শুনব না তাহলে আমি ফেরত চলে যাব। হযরতের এই জবাব সবার উপর এমন প্রভাব বিস্তার করল যে, সবাই বলে উঠল, হযরত আপনার ওয়াজ আমরা অবশ্যই শুনব, অবশ্যই শুনব।তারপর হযরত অনেক লম্বা বয়ান করলেন। আপনারাও হযরতের ওয়াজ পড়ে থাকবেন। হযরতের বয়ানে কথার পর কথা আসতে থাকে। ওয়াজে যাবতীয় ইখতিলাফী মাসায়েলের আলোচনা আসল। মীলাদের মাসআলা, কেয়ামের মাসআলা এরকম আরো যত মাসআলায় বেদআতীদের সঙ্গে মতবিরোধ আছে সব মাসআলার আলোচনা হল। যখন বয়ান শেষ হল এক লোক দাড়িয়ে বলল, হযরত, ওই চিরকুট আমিই পাঠিয়েছিলাম। আপনার কাছে বলছি, আমি মীলাদও করতাম, কিয়ামও করতাম। কিন্তু আজ আপনার বয়ান শোনার পর প্রকৃত সত্য আমার সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমি এই সব আকীদা থেকে তওবা করছি।এভাবেই আমাদের আকাবির দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন এবং বাতিলকে খন্ডন করে হক প্রমাণ করেছেন।আববাজান রাহ. বলতেন, পয়গাম্বরানা দাওয়াতের নীতি হল একদিকে কাফিররা এই বলে গালি দিচ্ছে যে, ‘আমরা তো তোমাকে বেওকুফ মনে করি, আমাদের ধারণা তুমি মিথ্যাবাদী।’অন্যদিকে পয়গাম্বর জবাব দিচ্ছেন, ‘না আমার মধ্যে বেওকুফী নেই। আমি তো তোমাদেরকে হেদায়েতের বাণী পৌঁছানোর জন্য একজন পয়গাম্বর হয়ে এসেছি।’গালির প্রতিউত্তরে গালি দেননি, নম্রতা ও কল্যাণকামিতার সঙ্গে শ্রোতার মনের ভিতর প্রবেশ করে কথা বলেছেন।

এই গুণ তখনই অর্জন করা যায় যখন সুনাম, সুখ্যাতি, জনপ্রিয়তা ইত্যাদির স্থলে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিই শুধু কাম্য হয়।হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর আরেকটি ঘটনাও আমি আববাজান রাহ.-এর কাছে শুনেছি। তিনি দিল্লী জামে মসজিদে ওয়াজ করছিলেন। তাঁর ওয়াজ অনেক লম্বা হত। ওয়াজ শেষে তিনি সিড়ি বেয়ে নিচে নামছেন এমন সময় একজন গ্রাম্য লোক এমনভাবে দৌড়ে এল যে, হাঁপাতে লাগল। সে ইসমাঈল শহীদ রাহ.কে সিড়ি বেয়ে নামতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, মৌলভী ইসমাঈলের ওয়াজ শেষ হয়ে গেছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ ভাই। শেষ হয়ে গেছে। সে বলল ইন্না লিল্লাহ, আমি তো অনেক দূর থেকে তার ওয়াজ শোনার জন্যই দৌড়ে এসেছি। হযরত ইসমাইল শহীদ রাহ. বললেন, আচ্ছা আপনি তাহলে তার ওয়াজ শোনার জন্যই এসেছেন? দেখুন, আমার নামই ইসমাঈল এবং আমিই ওয়াজ করেছি। আপনি সিড়িতে আমার সামনে বসে যান আমি আপনাকে সে ওয়াজ শুনিয়ে দিচ্ছি। এই বলে তাকে বসিয়ে দিলেন এবং একজন মানুষকে পূর্ণ দুই ঘন্টার ওয়াজ পুনরায় শুনিয়ে দিলেন।লোকেরা বলল, হযরত, একি আশ্চর্য ব্যাপার যে, আপনি শুধু একজন মানুষের জন্য পুনরায় এত লম্বা ওয়াজ করলেন? হযরত বললেন, ভাই! আমি প্রথমবার যে ওয়াজ করেছি তাও তো ‘একজনের’ জন্যই করেছিলাম। সুতরাং দ্বিতীয় ওয়াজও ‘একজনের’ জন্যই করেছি। তো যে ব্যক্তি খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার উদ্দেশ্য পরিহার করে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করবে তার কাজে বরকত হবে না তো কার কাজে হবে? তাঁর এক এক ওয়াজে শত শত মানুষ তওবা করত। এমন প্রভাব তখনই সৃষ্টি হয়, যখন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিই উদ্দেশ্য হয়। মানুষের প্রশংসা থেকে অমুখাপেক্ষী হয়।

তবে এই গুণ শুধু কিতাব পড়ে অর্জন করা যায় না। কোনো কামেল মানুষের শাসন প্রয়োজন হয়। আমি গতকাল আলোচনা করেছিলাম যে, ‘তাযকিয়া’ এ পথ ছাড়া অর্জিত হয় না। তা তখনই অর্জিত হয় যখন কোনো আল্লাহ ওয়ালার খেদমতে থেকে নফস ও নফসের খাহেশাতকে দলিত মথিত করা হয়। তবেই আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে তার লেখায় ও কথায় নূর পয়দা হয়।আমাদের হযরত আরেফী রাহ. একটি কথা বলতেন। কথাটি শুনিয়ে আমি আলোচনা শেষ করছি। তিনি বলতেন, তোমরা নিশ্চয়ই পোলাও-এর চাল দেখেছ। সেটা যতক্ষণ চাল থাকে ততক্ষণ তা শক্ত থাকে এবং আওয়াজ করে। তারপর যখন তাতে পানি ঢালা হয় এবং আগুনের উপর চড়ানো হয় তখনও যতক্ষণ কাচা থাকে ততক্ষণ আওয়াজ করতে থাকে। কিন্তু যখন তা সিদ্ধ হয়ে যায় এবং ঢাকনা চাপা দিয়ে তার শ্বাস নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন সব আওয়াজ বন্ধ হয়ে সম্পূর্ণ খামুশ হয়ে যায়। আর তখনই চারদিকে সুবাস ছড়িয়ে পড়ে।তো দেখুন, যতক্ষণ পর্যন্ত তা কাচা ছিল ততক্ষণ তা থেকে আওয়াজ আসছিল, টগবগ করছিল। কিন্তু তখন না কোনো স্বাদ ছিল, না সুবাস ছিল। যখনই আওয়াজ বন্ধ হয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল তখনই তার সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং অনেক মজাদার হয়ে গেল।হযরত বলতেন, আমাদের মতো কাঁচা তালিবে ইলমরা এভাবে আওয়াজ করতে থাকে। বিভিন্ন দাবি দাওয়ার আওয়াজ। কোনো আল্লাহ ওয়ালার কাছে চলে যাও। তিনি সেই সিদ্ধ হওয়া চাউলের মতো চেপে ধরে তোমার শ্বাস নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করবেন। তখন তোমার সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আল্লাহ তাআলা দয়া করে সকলকে এই মাকাম ও মর্যাদা দান করুন এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

[হযরত এ বয়ানটি করেছেন গত ৫/০২/০৯ ঈ. তারিখে ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা ঢাকায়। মূল উর্দূ বয়ান ক্যাসেট থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন মাওলানা সাঈদ আহমাদ এবং অনুবাদ করেছেন মাওলানা মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ।]

Loading