আরবী তারিখঃ এখন ১৯ রমজান ১৪৪৫ হিজরি মুতাবিক ২৯ মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রোজ শুক্রবার, সময় রাত ৯:৪৩ মিনিট
এলানঃ-
১৪৪৫-১৪৪৬ হিজরী, ২০২৪-২০২৫ ইং এর মাসিক সুন্নতী ইজতেমা সমূহ
* ২৫ এপ্রিল ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ৩০-৩১ মে ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৭ জুন ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ২৫-২৬ জুলাই ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৯ আগষ্ট ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ২৬-২৭ সেপ্টেম্বর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৪ অক্টোবর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ২৮-২৯ নভেম্বর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৬ ডিসেম্বর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ৩০-৩১ জানুয়ারী ২৫ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৭ ফেব্রুয়ারী ২৫ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* মার্চ ২৫ ইং এজতেমা সালেকীনদের জন্য

শবে বারাআত; নানামুখী চিন্তায় পূণ্যময় একটি রাত!

আমাদের দেশে শবে বারাআতকে কেন্দ্র করে নানামুখী চিন্তা-ভাবনা প্রচলিত রয়েছে ।

কেহ কেহ তো শবে বারাআতকে একদম ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করছেন ৷ আবার কেহ কেহ এ পূণ্যময় রাতটিকে উপলক্ষ্য করে নানা বিদআত ও রুসুমাতে জড়িত হয়ে পড়েছেন ৷

আবার তৃতীয় একটি অবস্থানে আছেন কিছু ওলামায়ে কেরাম ও তাদের অনুসারীগণ ৷
তাদের অভিমত হলো: শবে বারাআত প্রমাণিত ৷ এর বিশেষ কিছু আমলও রয়েছে ৷ তবে এর সঙ্গে চালু হয়ে পড়া সামাজিক প্রথা তথা রুসুমাতগুলো বিদআত ও বর্জনীয় ৷

আমি তৃতীয় এই অভিমতটিকে সমর্থন করি ।

এখন আমি প্রথমে শবে বারাআতের প্রমাণ পেশ করবো এরপর তার প্রমাণিত আমল অত:পর এ রাতে বর্জনীয় বিষয়গুলো আলোচনা করবো ৷

শবে বারাআত কী ?

“শব” ফার্সি শব্দ । অর্থ: রাত । আর বারাআত এটি আরবী শব্দ । براءة অর্থ হলো: “মুক্তি” ৷ লাইলাতুল বারাআত অর্থ হলো:জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত ৷

শবে বারাআতকে হাদিসের পরিভাষায় বলা হয়েছে:

ليلة النصف من شعبان

তথা মধ্য শাবানের রাত ।

অতএব,ফারসীর শবে বারাআত শব্দটি আরবীতে না পেলেই তাকে অস্বীকার করা উচিৎ নয় ৷

না হয় আপনি নামায রোজাও কুরআন হাদীসে খুঁজে পাবেন না ৷

কুরআনে শবে বারাআত:

কুরআনে কারীমে এই রাতকে ليلة مباركة বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ সূরায়ে দুখানে ২-৩ আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন-

اناانزلناه في ليلةمباركةاناكنامنذرين.فيهايفرق كل امرحكيم.

“নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি মুবারক রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী ৷ এই রাতে হিকমতপূর্ণ সব বিষয় সিদ্ধান্ত করা হয় ৷”

তাফসীরে দুররে মনসুর সহ বেশ অনেকগুলো তাফসীরে উল্লেখ রয়েছে যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ বলতে শবে বারাআতকে বুঝানো হয়েছে ৷

যদিও এ রাত বলে লাইলাতুল ক্বদরকে বুঝানো হয়েছে,এমন জোরালো অভিমতও রয়েছে ৷
তবে শবে বারাআত উদ্দেশ্য হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে….

হাদীসে শবে বারাআত

লামাযহাবী ভাইয়েরা শবে বারাআতের অস্তিত্বই স্বীকার করেন না ৷ অথচ কিছু সহীহ হাদীসে এ রাতের ফজীলতের কথা রয়েছে:

যেমন-

عن معاذبن جبل رض عن النبي صلى الله عليه وسلم قال:
يطلع الله تبارك وتعالى الى خلقه ليلة النصف من شعبان فيغفرلجميع خلقه الا لمشرك اومشاحن.

“হযরত মুআয বিন জাবাল রা: থেকে বর্ণিত রাসূল স: ইরশাদ করেন,আল্লাহ তা’আলা অর্ধ শাবানের রাতে সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক -বিদ্বেষী ছাড়া সবাইকে মাফ করে দেন৷”

( সহীহ ইবনে হিব্বান ১২/৪৮১ হাদীস নং-৫৬৬৫
হাদীসটির মান: সহীহ, মাজমাউয যাওয়ায়েদ- ৮/৬৫ )

আরেকটি সহীহ হাদীস:

عن عبدالله بن عمرو رض ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال يطلع الله عزوجل الي خلقه ليلة النصف من شعبان فيغفرلعباده الالاثنين مشاحن وقاتل نفس.

“হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রা: হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ স: ইরশাদ করেন- আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রাতে { ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে } তাঁর বান্দাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে দেখেন ৷ আর হিংসুক ও আত্মহত্যাকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন ।

( মুসনাদে আহমাদ ১১/২১৬ হা:৬৬৪২ , হাদীসের মান:সহীহ ৷ শুয়াইব আর নাঊত রহ:লেখেন “حديث صحيح بشواهده” )
একজন রাবী “ইবনে লাহীয়াহ”র ব্যাপারে কিছু দূর্বলতা থাকলেও অন্যান্য রেওয়াতে এর শাওয়াহেদ রয়েছে ৷

আরো বিভিন্ন হাদিসে শবে বারাআত

যেমন-

عن علي رض قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم: إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها . فإن الله ينزل فيها لغروب الشمس إلى السماء الدنيا . فيقول ألا من مستغفر فأغفر له ألا من مسترزق فأرزقه ألا من مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر ..

হযরত আলী রা: হতে বর্ণিত রাসূল সা: ইরশাদ করেন- যখন অর্ধ শাবানের রজনী আসে তখন তোমরা রাতে ইবাদত করো আর দিনের বেলা রোযা রাখো । নিশ্চয়ই আল্লাহ এ রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে প্রথম আসমানে নেমে আসেন ৷ আর বলেন-

কোন গোনাহ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি আমার কাছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো । কোন রিযিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিযিক দিবো । কোন বিপদগ্রস্থ আছে কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দিবো । আছে কি এমন, আছে কি তেমন?

এভাবে বলতে থাকেন সুবহে সাদিক পর্যন্ত ।

{ সূনানে ইবনে মাজাহ, পৃ:৯৯হাদীস নং-১৩৮৮, শুয়াবুল ঈমান, ৩/৩৭৮হাদীস নং-৩৮২২ } হাদীসটিতে শুধু একজন ছাড়া বাকী রাবীগণ ثقه তথা নির্ভরযোগ্য ৷ আর ফাজায়েলে আ’মালের জন্য যতসামান্য জয়ীফ পর্যায়ের হাদীস চলে বা আমলযোগ্য হয় ৷

عن عائشةرض : قالت فقدت رسول الله صلى الله عليه و سلم ليلة فخرجت فإذا هو بالبقيع فقال أكنت تخافين أن يحيف الله عليك ورسوله ؟ قلت يا رسول الله إني ظننت أنك أتيت بعض نساءك فقال إن الله عزوجل ينزل ليلة النصف من شعبان إلى السماء الدنيا فيفغر لأكثر من عدد شعر غنم كلب

“হযরত আয়শা রাঃ বলেন- এক রাতে রাসূল সাঃ কে না পেয়ে খুজতে বের হলাম ; দেখলাম তিনি জান্নাতুল বাকীতে । তিনি বললেন আয়েশা ! তুমি কি ভয় পাইতেছিলে যে , আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার উপর কোন জুলুম করবেন ?

হযরত আয়শা রা: বললেন- আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোন বিবির ঘরে গিয়েছেন । রাসূল সা: বললেন- যখন মধ্য শাবানের রাত আসে আল্লাহ তা’আলা প্রথম আসমানে নেমে আসেন । আর বনু কালব গোত্রের বকরীর পশমের চেয়ে বেশী সংখ্যক বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন । { সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৭৩৯ }

গায়রে মুকাল্লিদতথা লা মাযহাবীদের ইমাম শায়েখ নাসীরুদ্দীন আলবানী রহ: তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহাহ খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা নং ১৩৫ – এ শবে বারাআতের ফজীলতের হাদীসকে সহীহ মেনে নিয়ে বলেন:

“وجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب و الصحة تثبت بأقل منها عددا “

অর্থাৎ “সারকথা হলো এই যে , নিশ্চয়ই শবে বারাআতের ফজীলতের হাদিসটি এই সকল সূত্র পরম্পরা দ্বারা সহীহ এতে কোন সন্দেহ নেই । আর সহীহ এর চেয়ে কম সংখ্যক বর্ণনার দ্বারাও প্রমাণিত হয়ে যায় ৷

প্রসিদ্ধ গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা আ: রহমান মোবারকপুরী রহ: তাঁর কিতাবে { তুহফাতুল আহওয়াজীতে খন্ড ৩ পৃ:৩৮৪-৩৮৫ } শবে বারাআত সংক্রান্ত আয়েশা রা:এর হাদীস প্রসংগে বলতে গিয়ে লেখন-

اعلم انه قد وردفي فضيلة ليلةالنصف من شعبان عدة احاديث مجموعها يدل علي ان لها اصلا….فهذه الاحاديث بمجموعهاحجةعلي من زعم انه لم يثبت في فضيلةالنصف من شعبان شيئ.

“জেনে রাখো ! শবে বারাআতের ফজীলত সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদীস এসেছে ৷ যা প্রমাণ করে যে, এর ভিত্তি আছে ৷ শবে বারাআতের কোন ভিত্তি নেই এমন ধারণা যারা রাখে, সমষ্টিগতভাবে এ হাদীসগুলো তাদের বিপক্ষে প্রমাণ বহন করে ৷

এ রাতে করণীয় :

এ রাতের নির্দিষ্ট কোন আমল নেই ৷

উল্লেখিত সূরা দুখানের আয়াত দ্বারা বুঝা যায় এটা ভাগ্যরজনী ৷

আর হাদীস শরিফের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে নিম্নোক্ত আমলগুলো পাওয়া যায় :

১} ইস্তিগফার তথা আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা।

২} কবর যিয়ারত করা। তবে রাসূল স:গিয়েছেন একাকী ৷ আবার জীবনে এই একবারই ৷ তাই দল ধরে যিয়ারতে যাবে না ৷

৩} কিছু নফল ইবাদত করা ।

৪} পরদিন রোযা রাখা ।

এ রাতে বর্জনীয়:

১ ) হালুয়া রুটি: এর সাথে শবে বরাতের কোন সম্পর্কই নেই ৷

২ ) আতশবাজি-মোমবাতি জ্বালানো ৷ ইত্যাদি
এগুলো হিন্দু সভ্যতা থেকে এসেছে বলে আমার মনে হয় ৷

৩ ) আর এ রাতের কোন আমলকে সম্মিলিত রূপ দেয়া যাবেনা ৷

এসব কোনভাবেই প্রমাণিত নয় ৷

আমরা অনেকে আবার এ রাতে মাগরিব থেকে ওয়াজ-নসীহত করে মূল আমলের সময় নষ্ট করে ফেলি ৷

আবার অনেকে বেশী নফল পড়তে গিয়ে ফজরের জামায়াতও পাইনা ৷ যা মোটেও উচিৎ নয় ৷
বরং এশা আর ফজর জামাআতে আদায় করলে সারা রাত নফল পড়ার সওয়াব হবে ৷

অনেকে আবার রাকাআতের সংখ্যা বৃদ্ধির তালে পড়ে গিয়ে নামাযের মান নষ্ট করে দেন ৷ এটাও অনুচিৎ ৷
সঠিকভাবে সব হুকূক্বের রেআয়াত করে সামান্য যে পরিমাণ নামাযই আদায় হবে এটাই ঐরকম শত রাকাআতের চেয়ে উত্তম যা হক্ব অাদায় না করে দায়সারাভাবে পড়া হয়ে থাকে ৷

আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে দ্বীনের সহীহ কথা সহীহভাবে বুঝবার, শুনবার ও আমল করার তাওফীক দিন ৷ আমীন ৷

লেখকঃ মুফতি শফী কাসেমী দা. বা., জামিল মাদরাসা বগুড়া।

Loading