আরবী তারিখঃ এখন ১১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরি মুতাবিক ২০ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রোজ শনিবার, সময় সন্ধ্যা ৭:৩৩ মিনিট
এলানঃ-
১৪৪৫-১৪৪৬ হিজরী, ২০২৪-২০২৫ ইং এর মাসিক সুন্নতী ইজতেমা সমূহ
* ২৫ এপ্রিল ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ৩০-৩১ মে ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৭ জুন ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ২৫-২৬ জুলাই ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৯ আগষ্ট ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ২৬-২৭ সেপ্টেম্বর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৪ অক্টোবর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ২৮-২৯ নভেম্বর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৬ ডিসেম্বর ২৪ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* ৩০-৩১ জানুয়ারী ২৫ ইং বৃহস্পতিবার ফজর-শুক্রবার মাগরিব পর্যন্ত সালেকীনদের জন্য
* ২৭ ফেব্রুয়ারী ২৫ ইং বৃহস্পতিবার মাগরিব-ইশা মাদরাসার সকলের জন্য
* মার্চ ২৫ ইং এজতেমা সালেকীনদের জন্য

হযরত আবু হানিফা রহ. এর ব্যাপারে রসুলুল্লাহ সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেছিলেন?

বহুমাত্রিক মেধাবী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন মনীষী হলেন ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.)। ইমাম যাহাবি যাকে পৃথিবীর সর্বাধিক মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি বলে অভিহিত করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের পর যাদের ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) তাঁদের অন্যতম। তিনি খায়রুল কুরুন তথা উত্তম যুগের মহামনীষীদের একজন। তাঁর উদ্ভাবিত ফিক্হশাস্ত্র ও হানাফী মাযহাব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মনীষীকর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্ত।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী

সহীহ আল-বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, রসুলুল্লাহ (সা.) হযরত সালমান আল-ফারসী (রাযি.)-এর গায়ে হাত রেখে বললেন,

«لَوْ كَانَ الْإِيْمَانُ عِنْدَ الثُّرَيَّا، لَنَالَهُ رِجَالٌ – أَوْ رَجُلٌ – مِنْ هَؤُلَاءِ».

‚ঈমান যদি সুরাইয়া নক্ষত্রেরও থাকে, তবুও পারস্যবাসীদের মধ্য থেকে এক বা একাধিক ব্যক্তি তা ছিনিয়ে নিয়ে আসবে।“

সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে,

«لَوْ كَانَ الدِّيْنُ عِنْدَ الثُّرَيَّا، لَذَهَبَ بِهِ رَجُلٌ مِنْ فَارِسَ – أَوْ قَالَ – مِنْ أَبْنَاءِ فَارِسَ حَتَّىٰ يَتَنَاوَلَهُ».

‚যদি দীন সুরাইয়া নক্ষত্রেরও থাকে, তবু পারস্যের এক ব্যক্তি তা আহরণ করবেই।“

মুসনদে আহমদ ও মাওয়ারিদুয যমআন কিতাবেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত আছে।

উল্লেখ্য যে, মুহাদ্দিসীনে কেরামের দৃষ্টিতে (হাদীসে বর্ণিত) ঈমান, ইসলাম ও দীন সমার্থবোধক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত।

উপর্যুক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় শাফিয়ী মতাবলম্বী ইমাম জালালুদ্দীন আস-সুয়ুতী (রহ.) বলেন,

أَقُوْلُ: بَشَّرَ النَّبِيُّ ^ بِالْإِمَامِ أَبِيْ حَنِيْفَةَ فِي الْـحَدِيْثِ الَّذِيْ أَخْرَجَهُ أَبُوْ نُعَيْمٍ فِي «الْـحِلْيَةِ».

‚এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে, ইমাম আবু নুআইম প্রণীত হিলয়াতুল আওলিয়া গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসটিতে (যা সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম শরীফেও বর্ণিত আছে) রসুলুল্লাহ (সা.) ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।“

শাফিয়ী মতাবলম্বী আর একজন বিশিষ্ট ইমাম ইবনে হাজার মক্কী (রহ.) বলেন,

إن الإمام أبو حنيفة هو الـمراد من هذا الحديث ظاهر لا شك فيه.

‚এ হাদীস দ্বারা ইমাম আবু হানিফা’ই উদ্দেশ্য। এটি এমন স্পষ্ট যে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।“

শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) বলেন, ‚ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এ হাদীসের মূল উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত।“ তিনি আরও বলেন, ‚মেসোপটেমিয়া, (মাওয়ারাউন নাহার) খুরাসান এবং পারস্যের ইমামগণও এ ভবিষ্যদ্বাণীর অর্ন্তভুক্ত।“

প্রসিদ্ধ গায়রে মুকাল্লিদ আলিম নবাব সিদ্দিক হাসান খান বলেন,

صواب انست كہ ہم امام ابؔو حنيفۃؒ دران داخل است وہم جملہ محدثين فرس باشارة النص۔

‚সত্য কথা হচ্ছে, ইমাম আবু হানিফা যেমনিভাবে এ হাদীসের অর্ন্তভুক্ত, তেমনিভাবে নসের অকাট্য হুকুমের ইঙ্গিতে অন্য সকল পারসিক মুহাদ্দিসগণও তার অন্তর্ভুক্ত।“

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তখনো অনেক সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তাদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ সুপ্রমাণিত। তিনি কয়েকজন সাহাবি থেকে হাদীসও বর্ণনা করেন। প্রথম শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ এবং তাবিয়ী হওয়ার সুবাদে তিনি নিম্নের হাদীসের ফযীলত লাভে ধন্য। রসূল (সা.) ইরশাদ করেন,

عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ k، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ ^: «خَيْرُكُمْ قَرْنِيْ، ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ، ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ» – قَالَ عِمْرَانُ: لاَ أَدْرِيْ أَذَكَرَ النَّبِيُّ ^ بَعْدُ قَرْنَيْنِ أَوْ ثَلاَثَةً – قَالَ النَّبِيُّ ^: «إِنَّ بَعْدَكُمْ قَوْمًا يَخُوْنُوْنَ وَلَا يُؤْتَمَنُوْنَ، وَيَشْهَدُوْنَ وَلَا يُسْتَشْهَدُوْنَ، وَيَنْذِرُوْنَ وَلَا يَفُوْنَ، وَيَظْهَرُ فِيْهِمُ السِّمَنُ».

‚ইমরান ইবনে হুসাইন (রাদি.) থেকে বর্ণিত, রসূল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে আমার যুগের ব্যক্তিবর্গ। অতঃপর যারা পরবর্তী শতাব্দীতে অবস্থান করবেন। অতপর যারা তাদের পরবর্তী শতাব্দীতে অবস্থান করবেন। ইমরান ইবনে হুসাইন বলেন, রসূল (সা.) কি দুই শতাব্দীর কথা বলেছেন নাকি তিন শতাব্দীর কথা বলেছেন তা আমার স্মরণ নেই। রসূল (সা.) আরও ইরশাদ করেন, তোমাদের পর এমন অনেক জাতি-গোষ্টীর আবির্ভাব ঘটবে, যারা খেয়ানত করবে, তাদের মধ্যে আমানতদারি থাকবে না। তারা সাক্ষ্য দেওয়ার উপযুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও সাক্ষ্যদানের চেষ্টা করবে। তারা মানত করবে, কিন্তু তা পূরণ করবে না। তাদের নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় বস্তু হবে পানাহারের স্বাচ্ছন্দ্য।“

উপর্যুক্ত হাদীসে প্রথম তিন শতাব্দীর মনীষীদের ঈমান আমল ও তাকওয়ার বিশুদ্ধতার সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছে। এ হাদীস দ্বারা আরও প্রমাণিত হয় যে, তৃতীয় শতাব্দীর পর অনুকরণ-অনুসরণের উপযুক্ত লোকের অভাব দেখা যাবে। তাদের মধ্যে স্বার্থপরতা ও দুনিয়ার মোহ প্রাধান্য লাভ করবে। তারা শরীয়তের অনেক বিষয়ে অনধিকার র্চচা করবে। ইসলামের অলৌকিক কারিশমা হলো, চার মাযহাবের গোড়াপত্তন ও সিহাহ সিত্তাহর সংকলন তিন শতাব্দীর মধ্যেই সম্পন্ন হয়। এ তিন যুগের রবকতময় প্রভার পরবর্তী শতাব্দীতে পরিলক্ষিত হওয়ার কারণে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এ বিষয়ে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, চতুর্থ শতাব্দীর পর প্রণীত কোনো মাযহাব এর অনুসরণ নিরাপদ নয় এবং চার মাযহাবের অনুসরণ প্রত্যেক মুমিনের জন্য অপরিহার্য।

চার মাযহাবের ইমামদের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-ই হলেন সবার মান্যবর। তাঁর ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর পূববর্তী শীর্ষস্থানীয় ইমামগণ যে মন্তব্য করেছেন তাতে পরবর্তী যুগের কারও সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয় না। যাদের বিরুদ্ধে স্বয়ং রসূল (সা.) খেয়ানত, সাক্ষদানের অযোগ্যতা, মানতপূরণ না করা ও দুনিয়ার প্রতি লোভ-লালসার অভিযোগ করেছেন এমন লোকদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কোনো অধিকার থাকতে পারে না।

পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবে

হানাফী মাযহাবের আলোচনা

হানাফী মাযহাবের গ্রহণযেগ্যতা ও মকবুলিয়তের জন এতটুকুই যথেষ্ট যে, কোনো কোনো আসমানি কিতাবে উম্মতে মুহাম্মদিয়ার তিনজন ব্যক্তির গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে, যারা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ফিকহ বিষয়ে যুগের সকল মানুষের ওপর অগ্রগামী হবেন। তাঁরা হলন: ১. নু’মান ইবনে সাবিত, ২. মুকাতিল ইবনে সুলাইমান ও ৩. ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বাহ। আর কোনো কোনো রেওয়ায়েতে ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বাহর স্থলে কা’ব আহবারের নাম এসেছে।

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান ছিলন ইলম তাফসীরের প্রসিদ্ধ ইমাম। তিনি আতা, নাফি, মুহাদ ইবনে মুনকাদির, আবু যুবাইর, ইবনে সিরীন প্রমুখ তাবিয়ী হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রায়ই ইমাম আযম (রহ.)-এর প্রশংসা করে বলতেন, ইমাম সাহেব (রহ.)-এর মধ্যে এমন ১৫টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাঁর সমসাময়িক অন্য কোনা ব্যক্তির নিকট নেই।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)

সম্পর্কে উম্মাতের শীর্ষস্থানীয় মনীষীদের অভিমত

ফিক্হ ও হাদীসশাস্ত্রে ইমাম আযম (রহ.)-এর গভীর-অগাধ পাণ্ডিত্য ও বিভিন্নমুখী প্রতিভা সম্পর্কে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম যে মূল্যবান অভিমত ব্যক্ত করেছেন, তার ফিরিস্তি এত দীর্ঘ যে, এ জন্য স্বতন্ত্র পুস্তক রচনার প্রয়োজন রয়েছে। নিম্নে মুসলিম উম্মাহর কয়েকজন ইমামের অভিমত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:

ইমাম বুখারীর শায়খদের অভিমত

ঈসা ইবনে ইউনুস (রহ.): ইমাম বুখারী (রহ.)সহ সিহাহ সিত্তাহ রচয়িতাদের উস্তাদ খ্যাতিনামা মুহাদ্দিস ঈসা ইবনে ইউনুস বলেন, ‚তোমরা ওই বক্তিদের কখনো সত্যবাদী মনে করা না যারা ইমাম আযম (রহ.)-এর ব্যাপারে বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। কারণ আল্লাহর কসম, আমি তাঁর চেয়ে যোগ্য ফকিহ ও ইমাম আর কাউক দেখিনি। সিহাহ সিত্তাহ প্রণেতাদের শায়খ ইমাম আ’মাশকে কেউ কোনো প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন, এর যথার্থ উত্তর নু’মানই দিতে পারবে।“

ইয়াহয়া ইবনে আদম: সিহাহ সিত্তাহ প্রণেতাদের আরেক শায়খ ইয়াহয়া ইবনে আদমকে প্রশ্ন করা হলো, ইমাম আযম এর সমালোচনাকারীদের ব্যাপারে আপনার মতামত কি? তিনি উত্তরে বলেন, ‚তাঁর কিছু ইলমি আলোচনা তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছে, আর কিছু বুঝতে সক্ষম হয়নি।“ তিনি আরও বলেন, ‚ইলম ফিক্হ সম্পর্কে তাঁর সব মতামত ছিল একমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তো। এর মধ্যে যদি বিন্দু পরিমাণও পার্থীব স্বার্থ জড়িত থাকতো তাহলে হানাফী মাযহাব দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়তো না।“

আসাদ ইবনে হাকাম: আসাদ ইবনে হাকাম বলেন, ‚ইমাম আযম (রহ.)-এর সমালোচকেরা হয়তো মূর্খ অথবা বিদআতী।“

আবু সুলাইমান: আবু সুলাইমান বলেন, ‚ইমাম আযম (রহ.)-এর ফিকহী চিন্তাধারা বড়ই আশ্চর্যজনক ও বিষ্ময়কর। যারা তার কথা বুঝতে পারেনি, তারাই কেবল তাঁর থেকে বিমুখ হয়েছে।“

আবদুর রহমান ইবনে আল মাহদি: আবদুর রহমান ইবনে মাহদি বলেন, ‚আমি হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে সুফ্য়ান আস-সওরী (রহ.)-কে أمير الـمؤمنين في العلماء  হিসেবে পেয়েছি। সুফ্য়ান ইবনে উয়াইনা (রহ.)-কে أمير العلماء হিসেবে পেয়েছি। আবদুলাহ ইবনুল মুবারক (রহ.)-কে صراف الـحديث হিসেবে পেয়েছি। ইয়াহয়া ইবনে সাঈদকে قاضي العلماء হিসেবে পেয়েছি। আর ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে পেয়েছি قاضي قاضي العلماء হিসেবে। যে ব্যক্তি এ ছাড়া অন্য কিছু বলবে তাকে বনী সুলাইমের নর্দমায় নিক্ষেপ কর।“

আমিরুল মুমিনীন ফিল হাদীসের অভিমত: তৃতীয় শতাব্দীর কয়েকজন মুহাদ্দিসকে আমিরুল মুমিনীন ফিল হাদীস হিসেবে ভূষিত করা হয়। তারা হলেন, মিসআর ইবনে কিদাম (রহ.), ওয়াকি’ ইবনুল জাররাহ (রহ.) ও ইমাম শু’বা (রহ.)।

উপর্যুক্ত মহা-মনীষীগণ ছিলেন ইমাম আযম (রহ.)-এর প্রশংসাকারী, অথবা শিষ্য কিংবা তাঁর মাযহাবের অনুসারী।

বলখবাসীদের ইমাম মুকাতিল ইবনে হাইয়ান (রহ.) যিনি প্রখ্যাত হাদীসবিশারদ ও হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয, হাসান আল-বাসরী, নাফি’সহ তাবিয়ীদের বিরাট একটি জামাআতের সান্নিধ্য লাভ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি ইমাম আযম (রহ.)-এর খদমতেও উপস্থিত হয়েছেন। তিনি বলতেন যে, আমি তাবিয়ীদের যুগ পেয়েছি। কিন্তু ইজতিহাদী মাসআলায় ইমাম আবু হানিফা (রহ.) থেকে অধিক যোগ্য ও পরিপক্ক আর কাউকে দেখিনি। তিনি ফতোয়া প্রদানের সময় বলে দিতেন, এ ব্যাপারে কুফার শায়খ ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতও এটাই।

ইমাম যাহাবী (রহ.): ইমাম যাহাবী তাযকিরাতুল হুফ্ফায কিতাবে লিখেন, ইমাম আযম (রহ.)-এর সমসাময়িক প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইয়াযীদ ইবনে হারুন (রহ.) বলেন,

أَدْرَكْتُ أَلْفًا مِنَ الشُّيُوْخِ وَكَتَبْتُ مِنْهُمْ، فَمَا وَجَدْتُ أَفْقَهُ وَلَا أَرْوَعُ وَلَا أَعْلَمُ مِنْ خَمْسَةٍ، وَأَوَّلُـهُمْ أَبُوْ حَنِيْفَةَ.

‚আমি এক হাজার শায়খের সান্নিধ্য গ্রহণ করেছি এবং তাঁদের সূত্রে হাদীস লিপিবদ্ধ করেছি। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক ফিক্হবিদ, দীনদার ও জ্ঞানী পেয়েছি পাঁচজনকে। তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যক্তি আবু হানিফা (রহ.)।

হাফিয যাহাবী নিজ সনদে বর্ণনা করেন, ইমাম সুফ্য়ান ইবনে উয়াইনা বলেন,

لَـمْ يَكُنْ فِيْ زَمَانِ أَبِيْ حَنِيْفَةَ بِالْكُوْفَةِ رَجُلٌ أَفْضَلُ مِنْهُ وَلَا أَرْوَعُ وَلَا أَفْقَهُ .

‚ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর যুগে কুফায় তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দীনদার ও ফিক্হবিদ আর কেউ ছিল না।“

খতীবে বাগদাদী (রহ.): খতীবে বাগদাদী তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব তারিখু বাগদাদ কিতাবে নিজ সনদে খালাফ ইবনে আইয়ুবের এ উক্তি উল্লেখ করেছেন,

قال خلف بن أيوب: صار العلم من الله تَعَالَىٰ إِلَى مُحَمَّدٍ ^ ثم صار إلى أصحابه، ثم صار إلى التابعين، ثم صار إلىٰ أبي حنيفة وأصحابه فمن شاء فليرض، ومن شاء فليسخط.

‚খালাফ ইবনে আইয়ূব বলেন, ইলমে শরিয়ত আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁর ইলম স্বীয় সাহাবীদের নিকট পৌঁছেছে। আর তা তাবিয়ীগণের নিকট পৌঁছেছে। আর তাদের ইলম ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও তাঁর শিষ্যদের নিকট পৌঁছেছে। তাতে কেউ সন্তুষ্ট হোক বা অসন্তুষ্ট হোক, কোনো পরওয়া করার দরকার নেই।“

হাফিয ইবনে আবদুল বার: মালিকী মাযহাবে বিশিষ্ট ইমাম হাফিয ইবনে আবদুল বার (রহ.) ইমাম আবু দাউদ (রহ.)-এর এ উক্তি উল্লেখ করেন, ‚আল্লাহ তায়ালা ইমাম মালিক (রহ.)-এর প্রতি রহম করুন, তিনি ইমাম ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা ইমাম শাফিয়ী (রহ.)-এর প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, তিনি ইমাম ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা আবু হানিফা (রহ.)-এর প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, তিনি ইমাম ছিলেন।“

ইমাম আওযায়ী (রহ.):  ইমাম আওযায়ী আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহ.)-এর উদ্দেশে বলেন,

غبطت الرجل بكثرة علمه ووفور عقله استغفر الله تعالىٰ لقد كنت في غلط ظاهر، فإنه بخلاف ما بلغني.

‚আমি উক্ত ব্যক্তির (ইমাম আবু হানিফা’র ) প্রচুর ইলম এবং অসাধারন জ্ঞান-বুদ্ধির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়েছি। আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি, নিশ্চয় আমি তার ব্যাপারে ভুলের মধ্যে ছিলাম। কেননা তাঁর সম্পর্কে আমার যে অবগতি ছিল তিনি তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত।“

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মাযহাব শুধুমাত্র পরবর্তী যুগের চিন্তাশীল ও রুচিবান ইমামদের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল তাই নয়; তাঁর সমসাময়িক ইমামদের নিকটও ছিল সমাদৃত। তবে কিছু কিছু আলিম যারা তাঁর বিপরীত মত পোষণ করেছেন। এটি বিরোধিতা ও নিন্দার খাতিরে ছিল না; বরং তা ছিল স্বভাবজাত আত্মর্মাদাবোধ বা ইলমি গবষণার স্বার্থে এবং ইজতিহাদি চিন্তাধারার আলোকে। কুরআন-সুনাহ বিষয়ে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও শরীয়তের সচল গতি বেগবান করার প্রয়োজনে তা ছিল একান্ত অপরিহার্য।

হিংসা-বিদ্বেষ, কূৎসা রটনা ও নিন্দনীয় ভাষায় না হলে এতে দোষের কিছু নেই। প্রাথমিক অবস্থায় গুটি কয়েক আলিম তাঁর বিপরীত মত প্রকাশ করলেও বেশির ভাগ আলিম তার মাযহাবের গভীরতা অনুধাবন করে তাঁর অনুসরণ করেছেন এবং হানাফী মাযহাব যে কুরআন-সুন্নাহর সাথে সঙ্গতিশীল তা অকপটে স্বীকার করেছেন। ইমাম আবু হানিফার বিরুদ্ধে যারা অহেতুক ও অযৌক্তিক বিষোদগার করে তাদের কঠোর সমালাচনা করেছেন।

হানাফী মাযহাব সম্পর্কে উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলিমদের অভিমত

শাহ অলিউলাহ (রহ.): শাহ অলিউলাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রহ.)-এর কিছু কিছু রচনাবলিতে তাকলীদ ও হানাফী মাযহাব বিরাধী কিছু উক্তি পাওয়া যায়। যা ছিল তাঁর জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের। লা মাযহাবীরা এসব রচনাবলি দ্বারা অনেক ফায়দা লুটেছে। তবে তাঁর শেষ জীবনের লিখিত গ্রন্থে (ফুয়ুযুল হারামাইন) তিনি নিজেকে হানাফী বলে উল্লেখ করেছেন এবং পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন যে, আমাকে রসূল (সা.) বলেছেন যে, হানাফী মাযহাব এমন একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন পথ, যা অন্যান মাযহাবের তুলনায় সুন্নাতে নবভীর সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যশীল। যে মাযহাব ইমাম বুখারী (রহ.) ও অপরাপর সিহাহ সিাত্তাহ প্রণেতাদের যুগেই বিন্যস্ত ও পরিশীলিত আকারে উদ্ভাবিত হয়েছিল।

মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.): নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান رياض الـمرتاض কিতাবের ২১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এ কাশফ কাষ্মিনকালেও শরীয়ত পরিপন্থী প্রমাণিত হয়নি। তিনি ইমাম আযম (রহ.) সম্পর্কে বলেন, কোনো রকমের লৌকিকতিা ও চরমপন্থার আশ্রয় না নিয়ে বলছি, আমার মনে হচ্ছে, হানাফী মাযহাবের রীতিনীতি ও আলোকচ্ছটা বিশাল সমুদ্রতুল্য। আর অন্যান্য মাযহাবকে মনে হচ্ছে, ছোট ছোট নদী ও চৌবাচ্ছা। আর বাহ্যতও দেখা যায়, মুসলমানদের অধিকাংশই ইমাম আযম (রহ.)-এর মাযহাবের অনুসারী।

নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.): সুলতানুল আউলিয়া নিজামুদ্দিন আউলিয়া খাজা গঞ্জেশকরের উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, ইমাম আযম (রহ.)-এর শান-মানের কথা কি বলবো, তাঁর একজন ছাত্র ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) এতই উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন যে, যখন তিনি সওয়ার হয়ে কোথাও যেতেন, তখন ইমাম শাফিয়ী (রহ.) তাঁর ঘোড়ার লাগাম ধরে পদব্রজে চলতেন।

[i] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৬, পৃ. ১৫১, হাদীস: ৪৮৯৭

[ii] মুসলমি, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়তি তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ১৯৭২, হাদীস: ২৫৪৬

[iii] ইবনে হাজর আল-হায়সামী, আল-খায়রাতুল হাসান ফী মানাকিবিল ইমামিল আযম আবী হানীফা আন-নুমান, পৃ. ১৩

[iv] শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী, ইযালাতুল খিফা খিলাফাতিল খুলাফা, খ. ১, পৃ. ২৭১

[v] নবাব সিদ্দিক হাসান: দিরাসাতুল লাবীব, পৃ. ২৮৯

[vi] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ১৭১, হাদীস: ২৬৫১

[vii] তারেক আলী শাহ হাজারভী, ইমাম আবু হানিফা স্মারক গ্রন্থ, পৃ. ৫৩০

[viii] আল-মুওয়াফ্ফিক, মানাকিবুল ইমাম আল-আযম আবী হানীফা, খ. ২, পৃ. ৫৯

[ix] মুরতাযা আয-যুবাইদী, উকূদুল জাওয়াহির আল-মুনীফা ফী আদিল্লাতিল ইমাম আবী হানীফা, খ. ১, পৃ. ১১

[x] আল-খতীবুল বগদাদী, তারীখু বগদাদ, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৭ হি. = ১৯৯৭ খ্রি.), খ. ১৩, পৃ. ৩৩6

[xi] ইবনে আবদুল বারর, আল-ইনতিকা ফী ফাযায়িলস সালাযাতিল আয়িম্মাতিল ফুকাহা, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ২, পৃ. ১৬৩

Loading