এক.
শায়খ আহমাদুল্লাহ সাহেব ফিকহি মাসআলার সমাধানের ক্ষেত্রে সর্বদাই সালফে সালিহিনের বিপরিত পথে হাটেন। যে দেশের ৯৯ পার্সেন্ট সাধারণ মানুষ ফিকহে হানাফির অনুসারী, সেখানে তিনি ফতোয়া দিতে গিয়ে কখনও ফিকহে হানাফিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেন, কখনও ফিকহে হানাফির ফতোয়াকে আমাদের দেশের আলেমদের ফতোয়া বলে চালিয়ে দিয়ে এর বিপরিত সালাফি আরব আলেমদের মতামত অত্যন্ত গোছালোভাবে তুলে ধরেন! আবার কখনও সুন্নাহসম্মত মতপার্থক্যে আমাদের দেশে হাজার বছর থেকে চলে আসা আমলকে সরাসরি হাদিস বিরোধীও বলেন!
উপরের সবগুলো দাবির পক্ষে ভুরি ভুরি প্রমাণ দেওয়া যাবে। ইখতেলাফি মাসআলায় সার্বজনীন জবাবের নামে সর্বদা তিনি সালাফিদের প্রমোট করেছেন। দাম্মাল থাকাকালীন তার বক্তব্যগুলো আরও জগণ্য। সেগুলো তুলে ধরলে অনেকে বলে এগুলো তার পুরাতন বক্তব্য! কিন্তু তিনি তার পুরাতন বক্তব্য থেকে রুজু করেছেন, এমন কোন আলোচনা কখনও আমাদের নজরে পড়ে নি!
দুই
সম্প্রতি তিনি আকিদা সংক্রান্ত একটি জনসাধারণের জন্য একটি প্রতিযোগীতার আয়োজন করেছেন। আকিদার পাঠ্যবই হিসেবে তিনি নির্ধারণ করেছেন মরহুম আবদুল্লাহ জাহাংগির সাহেবের আকিদা সংক্রান্ত বিশাল কলরবের বইটি! আকিদার হাজার হাজার বই থাকতে এ সংক্রান্ত আবদুল্লাহ জাহাংগির সাহেবের বই নির্ধারণ করে শায়খ আহমাদুল্লাহ সাহেব তার অবস্থান আমাদের সামনে ক্লিয়ার করে দিয়েছেন! এ সম্পর্কে কথা বলার আগে প্রতিযোগিতা সম্পর্কে দুটি কথা বলতে চাই।
আমাদের এ দেশের ৯৯ পার্সেন্ট মানুষ আকিদার ক্ষেত্রে আশআরি এবং মাতুরিদি। আছারি কিংবা সালাফি হাতেগুণা কিছু মানুষ পাবেন। আল্লাহর অবস্থান সংক্রান্ত, আল্লাহর আকার নাকি নিরাকার, আল্লাহর আসমা ওয়া সিফাত সংক্রান্ত আলোচনায় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আকিদাতুত তাহাবির মোটাদাগের মৌলিক আকিদায়ই বিশ্বাসী। এগুলো নিয়ে গভীর আলোচনায় মানুষ কখনও যায় না। গভীর আলোচনায় যাওয়া সালাফদের একটি বিশাল অংশের মতে না যাওয়াই অনূচিত। আমি কয়েকজনের বক্তব্য আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
ইমাম বুখারী রাহি. এর উস্তাদ প্রখ্যাত মুহাদ্দিস সুফিয়ান বিন উয়াইনা রাহি. বলেন,
كُلُّ مَا وَصَفَ اللَّهُ بِهِ نَفْسَهُ فِي كِتَابِهِ فَتَفْسِيرُهُ تِلَاوَتُهُ وَالسُّكُوتُ عَنْهُ
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে তার গুণাবলি সংক্রান্ত যে আয়াতগুলো উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর তাফসির হলো তেলাওয়াত করা এবং চুপ থাকা। ফাতহুল বারী: ১৩/৪০৬।
তেলাওয়াত করার অর্থ হলো, আল্লাহ তাআলা তাঁর যাত বা সিফাতের ব্যাপারে যা কিছু পবিত্র কুরআনে বলেছেন, সব সত্য। চুপ থাকার অর্থ এই নয় যে, এগুলোর সত্য বলে বিশ্বাস করবেন না।
ইমাম তিরমিযী রাহি. এ ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,
وَقَدْ قَالَ غَيْرُ وَاحِدٍ مِنْ أَهْلِ العِلْمِ فِي هَذَا الحَدِيثِ وَمَا يُشْبِهُ هَذَا مِنَ الرِّوَايَاتِ مِنَ الصِّفَاتِ: وَنُزُولِ الرَّبِّ تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، قَالُوا: قَدْ تَثْبُتُ الرِّوَايَاتُ فِي هَذَا وَيُؤْمَنُ بِهَا وَلَا يُتَوَهَّمُ وَلَا يُقَالُ: كَيْفَ هَكَذَا رُوِيَ عَنْ مَالِكٍ، وَسُفْيَانَ بْنِ عُيَيْنَةَ، وَعَبْدِ اللَّهِ بْنِ المُبَارَكِ أَنَّهُمْ قَالُوا فِي هَذِهِ الأَحَادِيثِ: أَمِرُّوهَا بِلَا كَيْفٍ “، وَهَكَذَا قَوْلُ أَهْلِ العِلْمِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالجَمَاعَةِ،
অর্থাৎ আহলে ইলমরা এ হাদীস এবং আল্লাহর সিফাত সংক্রান্ত অন্যান্য মুতাশাবিহ বর্ণনার ব্যাপারে, প্রত্যেক রাতে আল্লাহ অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে বলেন, রেওয়ায়াত দ্বারা এগুলো প্রমাণিত হয়েছে এবং আমরা এগুলোর উপর ঈমান এনেছি। এগুলোর ব্যাপারে সন্দেহ করা যাবে না এবং জিজ্ঞাসা করা যাবে না যে , কীভাবে? এমনটি বর্ণিত হয়েছে মালিক, সুফিয়ান বিন উয়াইনা এবং আবদুল্লাহ বিন মুবারক রাহি. থেকে। এ সমস্ত ব্যাপারে তারা বলেন, কোন ধরণের ব্যাখ্যা ছাড়া এগুলো ছেড়ে দিন। এমনটাই হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মত। তিরমিযী: হাদীস নং ৬৬২।
আল্লাহর সিফাত সংক্রান্ত মুতাশাবিহ আরেকটি আয়াতের আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম তিরমিযী রাহি. বলেন,
وَهَذَا حَدِيثٌ قَدْ رَوَتْهُ الأَئِمَّةُ، نُؤْمِنُ بِهِ كَمَا جَاءَ مِنْ غَيْرِ أَنْ يُفَسَّرَ أَوْ يُتَوَهَّمَ، هَكَذَا قَالَ غَيْرُ وَاحِدٍ مِنَ الأَئِمَّةِ: الثَّوْرِيُّ، وَمَالِكُ بْنُ أَنَسٍ، وَابْنُ عُيَيْنَةَ، وَابْنُ الْمُبَارَكِ أَنَّهُ تُرْوَى هَذِهِ الأَشْيَاءُ وَيُؤْمَنُ بِهَا وَلاَ يُقَالُ كَيْفَ
অর্থাৎ এ হাদীসটি ইমামগণ বর্ণনা করেছেন। আমরা কোন ধরণের ব্যাখ্যা এবং সন্দেহ করা ছাড়া এর উপর ঈমান আনব। অনেক ইমামগণ এমনটি বলেছেন। উমাম ছাওরী, মালিক বিন আনাস, ইবনে উয়াইয়া, ইবনে মুবারক এমনটি বলেছেন। তাদের মতে এগুলো বর্ণনা করা হবে এবং ঈমান আনা হবে। কিন্তু কীভাবে বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না। তিরমিযী: হাদীস নং ৩০৪৫।
ইমাম বায়হাকী রাহি. ওয়ালিদ বিন মুসলিম থেকে বর্ণনা করেন,
سُئِل الأوزاعي ومالك وسفيان الثوري والليث بن سعد عن هذه الأحاديث التي جاءت في التشبيه، فقالوا: أمرُّوها كما جاءت بلا كيفية
অর্থাৎ আওজায়ী, মালিক, সুফিয়ান, লাইস বিন সাদকে আল্লাহর তাশবিহ সংক্রান্ত হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, এগুলোর কাইফিয়্যাত বা অবস্থা ছাড়া বর্ণনা করা ছাড়া যেভাবে এসেছে, সেভাবে চালিয়ে দিতে হবে। আস সুনানুল কুবরা: ২/৩।
শায়খ আহমাদুল্লাহ সাহেব আকিদার প্রতিযোগিতার নামে সাধারণ মানুষকে এ সকল গভীর বিষয়ে টেলে দিচ্ছেন!
তিন.
শায়খ আহমাদুল্লাহ পাঠ্যতালিকা হিসেবে যে বই নির্ধারণ করেছেন, সে বইয়ের লেখক আবদুল্লাহ জাহাংগির রাহি. মাসআলা বর্ণনার ক্ষেত্রে ইনসাফ বজায় রাখলেও আকিদার ক্ষেত্রে তিনি ইনসাফ বজায় রাখেন নি। তার আকিদা সংক্রান্ত আরেকটি বই নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রথিতযশা মুহাক্কিক আলেম মাও. মুহাম্মাদ আবদুল মালেক হাফি. লিখেন:
“ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেবের বাংলা ব্যাখ্যায় মাতুরিদী ও আশ‘আরীদের উপর ঢালাওভাবে কিছুটা কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে, যা মুনাসিব হয়নি। যদি তার পূর্ববর্তী মাতুরিদী ও আশ‘আরীদের কিতাবগুলো গভীরভাবে মুতালাআর সুযোগ হত তাহলে সম্ভবত এমন সমালোচনা করতেন না। অপর দিকে তিনি কট্টরপন্থী সালাফীদের ব্যাপারে (এমনকি এই যুগের এই এলাকার সালাফীদের ব্যাপারেও) কোনো বিশেষ সমালোচনা করেননি। এটাকে একটি ত্রুটিই বলতে হবে, যা সম্ভবত পর্যাপ্ত মুতালাআ ও মুযাকারার সুযোগ না হওয়ার কারণে ঘটেছে। -আলকাউসার
সিফাতে মুতাশাবিহাতের মধ্যে তিনি লম্বা আলোচনা করেছেন কিন্তু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর আসল মাসলাক তার আলোচনা থেকে ফুটে উঠেনি। মোদ্দাকথা, এই কিতাবে নযরে ছানীর দরকার ছিল।”
আবদুল মালেক সাহেবের বক্তব্য মূলত আ ফিকহুল আকবার সংক্রান্ত। কিন্তু একই কথা ইসলামী আকীদার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শায়খ আহমাদুল্লাহ সাহেব এ বই সিলেক্ট করার মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে আকিদার ক্ষেত্রে তিনি সালাফি। আবদুল্লাহ জাহাংগির সাহেবের বইয়ের আকিদাই তার আকিদা। আকিদার ক্ষেত্রে তিনি আশআরি মাতুরিদি নন। সালাফিদের মতোই তিনিও আশআরি মাতুরিদের আহলুস সুন্নাহ বহির্ভূত বেদআতি মনে করেন!
আমরা আশা করি শায়খ আহমাদুল্লাহ তার অবস্থান ক্লিয়ার করবেন। তিনি আকিদাগত দিক থেকে আশাআরি, মাতুরিদের হক মনে করেন কিনা সেটাও স্পষ্ট করবেন। আবদুল্লাহ জাহাংগির সাহেবের আকিদা ব্যাপারে আবদুল মালেক সাহেবের আপত্তিরও ওজাহাত করবেন।
শায়খ আহমাদুল্লাহ হাফি. এর আকিদা, ফিকহ এবং ফতোয়া নিয়ে অনেক কথা বলার আছে। সামনে সেগুলো নিয়ে লিখব এবং ভিডিও আলোচনাও করব ইনশাআল্লাহ।
লেখক: মুফতী রেজাউল করিম আবরার দা. বা.
পড়েছেনঃ 717 জন