পরিচিতি
বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির আকাশে মুফতী ফজলুল হক আমিনী নামটি চিরকাল নক্ষত্রের ন্যায় জ্বলজ্বল করবে। তার রাজনীতিতে কোন খাদ ছিল না। খাদ ছিল না তার ইসলামের প্রতি ভালবাসাতেও। এই কিংবদন্তি আলেম রাজনীতিবিদ ১৯৪৫ সালের ১৫ই নভেম্বর বিবাড়ীয়া জেলার আমীনপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ও দ্বীনদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষাজীবন
বিবাড়ীয়া জামেয়া ইউনুসিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলাধীন বিক্রমপুরের মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসায় তিন বছর পড়াশুনা করেন। তারপর ১৯৬১ সালে রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসায় চলে আসেন। এখানে তিনি হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ. ও হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ., কিংবদন্তী মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ রাহ., শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক রাহ., আরেফ বিল্লাহ মাওলানা সালাহ উদ্দীন রাহ. এবং হযরত মাওলানা আব্দুল মজীদ ঢাকুবী রহ. -এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে দাওরায়ে হাদীসের সনদ লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রহ. এর কাছে হাদীস পড়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান করাচী নিউ টাউন মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি উলুমুল হাদীসের উপর পাঠ গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসেন।
কর্মজীবন
কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে। প্রথমে মাদরাসা-ই- নূরিয়া কামরাঙ্গীরচরে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই তিনি হজরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর কন্যার সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭২ সালে মাত্র নয় মাসে তিনি কুরআন শরীফ হেফয করেন। এ সময় তিনি ঢাকার আলু বাজারে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। একই সাথে আলু বাজার মসজিদের খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭৫ সালে তিনি জামেয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসার শিক্ষক ও সহকারী মুফতী নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি লালবাগ জামেয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রধান মুফতীর দয়িত্ব পান। ১৯৮৭ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর ইন্তেকালের পর থেকে তিনি লালবাগ জামেয়ার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালে পান বড়কাটারা হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব। ইন্তেকালের আগ পর্যন্তই এই দুইটি মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পাশাপাশি ঢাকার কাকরাইল, দাউদকান্দির গৌরীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু মাদরাসার প্রধান অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
মুফতী আমিনী রহ. একজন প্রজ্ঞাবান বড় আলেম ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী দুটি বড় মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীস ছিলেন। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হিসেবে সরব একজন ইসলামী রাজনীতিক ছিলেন। তার পরিচয় এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।
গত দুই যুগ ধরে তিনি ছিলেন এদেশের ধর্মপ্রাণ-দেশপ্রেমিক মানুষ ও সর্বস্তরের আলেম সমাজের একজন প্রধান প্রতিনিধি। তিনি তাদের ভাই ছিলেন। তিনি তাদের দুঃখ ও দ্রোহের কণ্ঠ ছিলেন। তিনি তাদের বন্ধু, নেতা ও অভিভাবক ছিলেন। সঙ্কটকালে তার গমগমা কণ্ঠ আর হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন তারা। আহা! এত সুন্দর করে জনসভা ও মাহফিলগুলোতে ইসলামের অতীত গৌরব, বীরত্ব, আশাব্যঞ্জকতা, উদ্দীপনা, আল্লাহনির্ভরতা আর সাহসের পঙক্তিমালা তিনি উচ্চারণ করতেন যে মুহূর্তের মধ্যেই লাখো মানুষের ছায়াচ্ছন্ন, চিন্তাক্লিষ্ট চেহারায় প্রত্যয় ও আশ্বাসের রোদ হেসে উঠত। তিনি তার বক্তব্যে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা পেশ করতেন।
আশির দশকের শুরু পর্যন্ত তিনি ছিলেন অতি মনোযোগী ও নীরবতাবাদী একজন মেধাবী আলেম-শিক্ষক। তার শিক্ষক ও অভিভাবক হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. তাকে রাজনীতিতে নামালেন। ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সেই যে নামলেন তিনি, আর সরে গেলেন না। তিনি যখন গেলেন তখন কোটি মানুষকে রাস্তায় রেখে একদমই তিনি চলে গেলেন।
রাজনীতিতে পদার্পণ
নব্বই দশকের শুরুতে ভারতের উত্তর প্রদেশে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হলে এই দেশে লংমার্চের ডাক দেয়া হয়। সেই লংমার্চ আন্দোলনের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ও প্রধান নির্বাহী ছিলেন মুফতী আমিনী রহ.। তার শিক্ষক শায়খুল হাসীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ছিলেন এ লংমার্চের আহ্বায়ক ও অভিভাবক। মুফতী আমিনী ছিলেন এর কার্যনির্বাহী প্রধান।
১৯৯৪ সালে তসলিমা নাসরিন পবিত্র কুরআন পরিবর্তনের ডাক দিলে তিনি ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সারা দেশে ছুটে বেড়িয়ে আন্দোলন সংগঠিত করেন। হরতাল পালন করেন। সেই মুরতাদ তসলিমা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
২০০১ সালে সব রকম ফতোয়া নিষিদ্ধ করার একটি রায় উচ্চ আদালত থেকে ঘোষিত হলে তিনি বিচারপতিকে মুরতাদ ঘোষণা করে ঝুঁকিপূর্ণ ও ঘটনাবহুল এক আন্দোলনে নেমে পড়েন। তখন চার মাসের জন্য তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। বর্তমান সরকার ঘোষিত শিক্ষানীতি ও নারীনীতি নিয়ে তিনি সোচ্চার প্রতিবাদ করেন। নারীনীতির মধ্যে উত্তরাধিকারসহ সবপর্যায়ে নারীর সম-অধিকারের কুরআনবিরোধী ধারা বাতিলের জন্য দেশবাসীর প্রতি আন্দোলনের ডাক দেন। এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে বহু প্রতিকূলতা ও প্রশাসনিক প্রতিরোধের মুখে ২০১১ সালের ৪ এপ্রিল দেশব্যাপি সফল হরতাল পালন করেন। এর ঠিক ছয়দিন পর তার ছোট ছেলেকে গুম করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাকে কোনোভাবেই নমনীয় করা যায়নি। পরবর্তী সময়ে সেই ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। প্রতিটি আন্দোলনেই তিনি ছিলেন মূল আহ্বায়ক এবং আগাগোড়া অনমনীয় ও দৃঢ়পদ। সারাদেশের শীর্ষ আলেমরা প্রতিটি আন্দোলনে তার সঙ্গে ও পাশে থেকে তাকে সহযোগিতা করেন। প্রতিবাদ, আন্দোলন, সংগ্রামে ধর্মপ্রাণ মানুষের আস্থা ও আশ্বাসের মিনারে পরিণত হন তিনি।
আন্দোলন-সংগ্রামে প্রবীণত্ব ও নেতৃত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি সব সময় সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন ছিলেন না। কিন্তু কার্যনির্বাহী দায়িত্ব তাকেই আঞ্জাম দিতে হয়েছে সব সময়। তার সময়কালে প্রায় সময়ই তিনি তার গুরুজনদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ স্নেহ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছেন। খতিব উবায়দুল হক রাহ., বি-বাড়িয়ার বড়হুজুর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম রাহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রাহ. ও আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মতো বটবৃক্ষরা সব সময় তাকে স্নেহ-ছায়া বিলিয়ে এসেছেন। বড়দের সঙ্গে তিনি এভাবেই শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক বজায় রাখতেন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
মুফতী আমিনী রহ. মেধাবী ও সংগ্রামী একজন আলেম ছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিচরণের কারণে তার আচরণে কখনো কখনো একটা আটপৌড়ে ও গাম্ভীর্যহীন ভাব বিরাজ করত। খোলামেলা ভাষায় বক্তব্য দিতেন। প্রাণ খুলে মিশতেন। জোরের সঙ্গে কখনো বিরক্তি প্রকাশ করতেন। কখনো বয়ানের মধ্যেও হেসে উঠতেন। যা দেখলে অনেক সময় তাকে গভীর মনের ও চিন্তার মানুষ বলে মনে হতো না। একটা বিভ্রম তৈরি হতো। কিন্তু বাস্তবতা এ রকম ছিল না। যারা জানেন তারা জানেন যে, তিনি কেবল হাদীসের দরসের প্রস্তুতির জন্য নয়, বরাবর অধ্যয়ন পাগল একজন মানুষ ছিলেন। গভীর অধ্যয়ন ও পাঠনিমগ্নতায় তিনি অনেক সময়ই বিভোর থাকতেন। মাঝে মাঝেই ইসলামী জ্ঞান, দর্শন, ফিকহ ও চিন্তাধারা বিষয়ে নতুন প্রকাশিত আরবি-উর্দু-ফার্সির বহু কিতাব কার্টন ধরে ধরে তিনি কিনে আনতেন। ইসলাম বিষয়ে আলোচিত নতুন প্রকাশিত কোনো গ্রন্থ তার অপঠিত থাকত না। লালবাগ মাদরাসার বিশাল লাইব্রেরির প্রাচীন শত শত কিতাবের কোনো কোনো পৃষ্ঠায় কাঠপেন্সিলে তার নোট ও পর্যবেক্ষণ আঁকা আছে। তার অন্তরে আচরণে আধ্যাত্মিকতার একটি স্বচ্ছ ঝর্ণা প্রবাহিত থাকতো। বেশিরভাগ সময়ই তার বক্তব্যে থাকতো আকাবিরে দ্বীন ও আসলাফে উম্মতের চোখভেজা বর্ণনা।
বছরের প্রায় প্রতি রাতে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেঁদে-কেটে দুআ করতেন। এ দুআ কখনও মাদরাসায় তার রুম বন্ধ করে করতেন, কখনও ছাত্রদের ডেকে এনে দফতরে সম্মিলিতভাবে করতেন। দুআয় সময় দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকতেন। সে কান্না সহজে শেষ হতো না। লালবাগ মাদরাসায় প্রতি বৃহস্পতিবার শেষ রাতে তিনি একটি সম্মিলিত দুআর আয়োজন করতেন। রাত ৩টার আগেই সারা মাদরাসার ছাত্ররা উঠে এসে শাহী মসজিদের বারান্দায় তাহাজ্জুদ পড়ত। তেলাওয়াত করত। ফজরের আযানের আধা ঘণ্টা আগে তিনি সবার মুখোমুখি দাঁড়াতেন। এরপর সবাইকে নিয়ে দু’হাত আল্লাহর দরবারে তুলে ধরতেন। সামনে ছাত্ররা বসা। উল্টোদিকে একা তিনি দাঁড়ানো। মসজিদের বাতিগুলো থাকত নেভানো। রাজনীতির ময়দানে হুঙ্কার দেয়া মুফতি আমিনী সেই অন্ধকার শেষ রাতে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে অসহায়ের মতো, ভিক্ষুকের মতো, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর মতো চিৎকার করে কাঁদতে থাকতেন।
ইন্তেকাল
আওয়ামী দুঃশাসনের অন্যতম হুমকি এই নিরপরাধ মানুষটি দীর্ঘ বিশ মাস ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের নজরবন্দীতে গৃহরুদ্ধ হয়ে থাকেন। এই সময়ে চিকিৎসার উপরেও সরকারী খড়গ ঝুলে থাকে। সারাজীবন জনতার ময়দান দাপিয়ে বেড়ানো এই মহান নেতাকে এভাবেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়। ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার দিকে যাত্রা করেন। সারাদেশের মানুষ ও প্রকৃতির মাঝেও সেদিন শোকের ছায়া নেমে আসে। পরদিন ১২ ডিসেম্বর লক্ষ লক্ষ মানুষ জাতীয় ঈদগাহে তার জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। এমন অভূতপূর্ব ভালবাসার নিদর্শনের জুড়ি মেলা ভার হবে বহুদিন। জানাযা শেষে এই মহান আলেমকে তাঁর প্রিয় শিক্ষাঙ্গন লালবাগ জামিয়া সংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।