মাদরাসা পরিচালনার নিয়ম কানুন

পৃথিবীতে দ্বীন টিকিয়ে রাখার জন্য মাদরাসা জরুরী। কিন্তু মাদরাসা দ্বারা তখনই দ্বীন রক্ষার খেদমত আশা করা যায়, যখন মাদরাসার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে সহীহ উসূল অনুযায়ী চলবে এবং মাদরাসাকেও সহীহ উসূল অনুযায়ী চালাবে। অন্যথায় না দ্বীনের হেফাযত হবে আর না নিজেদের উন্নতি সাধন হবে বরং সময় আর অর্থ নষ্ট ছাড়া কিছুই হবে না। প্রত্যেকটা মাদরাসা যেন দ্বীন রক্ষার একেকটা কেল্লায় পরিণত হতে পারে তাই নিম্নে মাদরাসার কমিটি, ছাত্র, শিক্ষক ও মুহতামিম এর জন্য দিকনির্দেশনামূলক সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা করা হলো। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের উক্ত আলোচনার উপর আমল করার তাওফিক দান করুন!

১. আমরা মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটি হই আর মুহতামিম হই বা সাধারণ শিক্ষক হই, আমাদের নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য দু’টি কাজ করতে হবে।

ক. কোন হক্কানী বুযুর্গের সুহবত অবলম্বন করতে হবে এবং তার সাথে ইসলাহী সম্পর্ক কায়েম রাখার মাধ্যমে দিলের দশটা রোগ থেকে মুক্ত হওয়া এবং দশটি গুণ অর্জন করার মেহনত করতে হবে।

খ. নিজের ঈমান ও আমলের তরক্কীর জন্য দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত করতে হবে। কারণ ব্যক্তি যতক্ষণ নিজের উন্নতির ফিকির না করে সে যতই উম্মতের ফিকির করুক তার দ্বারা কোন কাজ হয় না। খুব ভাল করে জানা দরকার,কোন ব্যক্তি নিজের ঈমান আমলের উন্নতির চিন্তা ফিকির না করলে তাকে দিয়ে আল্লাহ ইসলামের কাজ নিবেন না। বস্তুত নিয়ত থাকবে নিজের উন্নতির, এর মধ্য দিয়ে অন্যের উন্নতিও হয়ে যাবে। নিজের ফিকির না করে আগে অন্য লোককে ঠিক করতে গেলে শুরুতেই তার থেকে অহংকার প্রকাশ পায়। আর আল্লাহ তা‘আলা অহংকারী থেকে দ্বীনের খেদমত নেন না।

২. আমাদের মাদ্রাসা জীবিত মাদরাসা না মৃত মাদরাসা? মৃত মাদরাসা বলে ঐ মাদরাসাকে যেখানে শিক্ষকদের সকল মেহনত ছাত্রদের মধ্যে সীমিত; বাইরের জনগণের দ্বীনী উন্নতির জন্য তাদের কোন ফিকির ও মেহনত নেই।

একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয় ছাত্রের নামে এবং তা পরিচালিত হয় টাকার মাধ্যমে। ছাত্র এবং অর্থ এই দুই জিনিসতো আসবে জনগণ থেকে। আর জনগণ এগুলো তখনই দিবে যখন তাদের জন্য আমাদের মেহনত থাকবে এবং তাদের মধ্যে দ্বীন থাকবে। আর এটাই মূলনীতি কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে। তাদেরকে কিছুই দিব না, শুধুই চাইতে থাকবো, তাহলে কিছুই পাওয়া যাবে না। যে মাদরাসা শুধুই ছাত্রদের পিছনে মেহনত করে, বাইরে কোন মেহনত করে না সেটা হল মৃত মাদরাসা। আর যে মাদরাসা ছাত্রদের উপর মেহনত করার সাথে সাথে বাইরের মানুষের ঈমান-আমল ও কুরআন সহীহ করে দেয়া, জরুরী মাসায়িল শিখানো ইত্যাদির মেহনত করে সেই মাদরাসা হলো জিন্দা মাদরাসা। জনগণের দীনি তরক্কীর জন্য মাদরাসা পরিচালক এবং আসাতিযায়ে কেরাম নিম্নোক্ত উপায়ে মেহনত করতে পারেঃ

আম জনতা ও এলাকাবাসীর উপর দুই লাইনে মেহনত করবেঃ

(ক) তাবলীগের লাইনে ।

(খ) দাওয়াতুল হকের লাইনে।

তাবলীগের দ্বারা ঈমান শিখাবে আর দাওয়াতুল হকের দ্বারা যাবতীয় আমলের মেহনত করবে। যেমনঃ নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ, বিবাহ-শাদী কাফন-দাফন ইত্যাদি সুন্নাত মোতাবেক করার প্রশিক্ষণ দেয়া। তাবলীগের দ্বারা জনগণের ইমান মজবুত হবে এবং তাদের মাঝে আমলের আগ্রহ পয়দা হবে। আর দাওয়াতুল হকের মাধ্যমে তাদের আমল বিশুদ্ধ ও সুন্নাত তরীকায় হবে এবং তারা সহী সুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে শিখবে।

প্রয়োজনে আশপাশের একেক গ্রামকে একেক শিক্ষকের দায়িত্বে দিয়ে দিবে। তারা ঐ গ্রামের মানুষকে তাবলীগে পাঠাবে। আমলী মশকের মাধ্যমে উযু নামায ও যাবতীয় আমলের সুন্নত তরীকা শিখাবে। নূরানী পদ্ধতিতে ২/৩ মাসে চক স্লেটের মাধ্যমে তাদের কুরআন সহী করে দিবে। এভাবে ২/৩ মাস চলার পর তার পার্শ্ববর্তী গ্রামে পর্যায়ক্রমে কাজ করবে।এতে কোন গ্রামের কোন লোক মাদরাসার বিরুদ্ধে থাকবে না; বরং প্রতিটি লোক মাদরাসার পক্ষে এসে যাবে। আর এভাবেই মাদরাসা জিন্দা মাদরাসা হবে। নতুবা মাদরাসা মুর্দা থেকে যাবে।

শুধু শিশু ছাত্রদেরকে পড়ালে হবে না; পাকা দাঁড়ীওয়ালাদেরকেও ছাত্র বানাতে হবে, যাদের কবরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। মুহতামীম সাহেব সর্বস্থানে তদারকী করবেন। কোন উস্তাদ কতটুকু কাজ করলেন তার তদারকী করবেন। এবং ঐ সকল গ্রামবাসীর ইন্টারভিউ নিবেন। দায়িত্বশীল উস্তাদগণ স্ব-স্ব এলাকায় গিয়ে আসরের নামায আদায় করবেন এবং মাগরিবের আগ পর্যন্ত উক্ত মেহনত করবেন।

ছাত্রদের উপর দুই লাইনে মেহনত করতে হবে:

(ক) তা‘লীম।

(খ) তরবিয়াত।

তা‘লীম অর্থ কিতাব পড়ানো আর তরবিয়াত হল কিতাবের ছাপানো লেখাগুলো তার শরীরে ছেপে দেয়া অর্থাৎ তাদের আমলী জীবন গঠন করে দেয়া, বাংলাতে যাকে বলে শিক্ষা-দীক্ষা। এর জন্য উস্তাদদের ‘সুহবাত ইয়াফতাহ’ হতে হবে এবং ছাত্রদেরকে হক্কানী শাইখের সুহবতে বসার ব্যবস্থা করতে হবে।

মাদরাসার হিসাব যেভাবে রাখবে:

মাদরাসা পরিচালনার ক্ষেত্রে আরেকটি জরুরী বিষয় হলো, মাদরাসার হিসাবটা খুবই মজবুতভাবে রাখবে। যে যেই উদ্দেশ্যে মাদরাসায় দান করবে তার টাকা সেই কাজেই ব্যয় করবে। কোন সময় যাকাত ফান্ডের টাকা যেন সরাসরি বেতন ফান্ডে না আনা হয় বা নির্মাণে খরচ না করা হয়। টাকা খাত ওয়ারী ব্যয় করতে হবে। খরচ যদি গলতভাবে করা হয় তাহলে ঐ মাদরাসার কোন ছাত্র আল্লাহওয়ালা হবে না। কোন মাদরাসায় যদি মাদরাসার সম্পদের ব্যবহার সহীহভাবে না হয় সেখান থেকে সহীহ আলেম পয়দা হয় না।

জেনেশুনে কারো হারাম টাকা নেয়া যাবে না। জানা আছে যে, এক লোকের পূর্ণ মালই হারাম-তাহলে তা নেয়া যাবে না। হ্যাঁ, নিলে সেটা টয়লেটের কাজে লাগাতে হবে। এ টাকা দিয়ে বেতন দিলে বা লিল্লাহ বোডিং এ ব্যয় করলে ছাত্র গড়বে না। আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে খাত ঠিক রাখতে হবে।

তবে লিল্লাহ ফান্ড থেকে অন্য ফান্ডের জন্য সাময়িক করজ নেয়া জায়িয আছে। তবে তা ফেরত দিতে হবে। অথবা সহীহ পদ্ধতিতে শরঈ তামলীক করতে জানলে সেভাবে করবে। প্রচলিত হিলার আশ্রয় নিবে না, যার দ্বারা মানুষের যাকাত কুরবানী নষ্ট হয়ে যায়।

আমাদের মুরব্বীগণ বলেছেন, মাদরাসা এমন দ্বীনী প্রতিষ্ঠান, যেখানে দু’টি জিনিস যথাযথ সংরক্ষণ করা হয়। ১.মুসলমানদের সন্তানদের সঠিকভাবে তা’লীম তরবিয়াতের মাধ্যমে হিফাযত করা অর্থাৎ ইলম ও আমল শিখানো হয়।

২. মুসলমানদের অনুদান সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে হিফাযত করা। অর্থাৎ মালগুলো সঠিক খাতে খরচ করা এবং প্রত্যেকটি পয়সার হিসাব রাখা। প্রত্যেকটা আয় রশিদের মাধ্যমে হতে হবে, আর প্রত্যেকটি ব্যয় খরচের ভাউচারের মাধ্যমে হতে হবে। রশিদ ব্যতীত কোন টাকা মাদরাসায় জমা নেয়া হবে না। সব টাকা রশিদ দ্বারা মাদরাসায় ঢুকবে আর খরচের ভাউচারের মাধ্যমে মাদরাসা থেকে বের হয়ে যাবে। পাকা খাতা তথা ক্যাশ বুক থাকবে, যেখান থেকে খাতওয়ারি লেজার বুকে যাবে।

হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. বলেছেন, ক্যাশের সাথে তোমরা চারজন লোককে জড়িত কারো যাতে মাদরাসার সম্পদে কোন খেয়ানত না হয়। যার ব্যাখ্যা নিম্নরুপঃ

১. মুহতামিম বা নায়েবে মুহতামিমঃ তাঁর কাজ হল ভাউচার অনুমোদন দেয়া। এভাবে যে, তিনি দেখবেন, এই খরচটা আদৌ প্রয়োজনীয় কিনা বা কত কম টাকায় এটা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায়। এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন মুহতামিম বা তার নায়েব।

২. আর কমিটির কাউকে দায়িত্ব দেয়া হবে মাসে বা সপ্তাহে একবার ভাউচারে সই করার জন্য । তাহলে ওটা হবে চূড়ান্ত অনুমোদন।

৩. যিনি ক্যাশিয়ার হবেন, তার কাছে রশিদের মাধ্যমে টাকা জমা হবে আর অনুমোদিত ভাউচারের মাধ্যমে খরচ হবে। রশিদ দেখে-দেখে খাতার মধ্যে টাকা জমার সাইডে জমা করবে। আর যে ভাউচারগুলো অনুমোদন হয়ে এসেছে সেগুলো ডান পাশে খরচের পাতায় লেখবে। খাতার বাম পাশে জমা লিখতে হয়, আর ডান পাশে খরচ। ক্যাশিয়ারের একটা নিজস্ব খাতা থাকবে যাকে বলে জার্নাল বা কাচা খাতা। এটা নিজস্ব হিসাব ঠিক রাখার জন্য, যাতে পকেট থেকে ভর্তুকি দেয়া না লাগে। এই দায়িত্বে যারা থাকবে তাদের খুব ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে, খাতায় খরচের কথা না লিখে কাউকে টাকা দিবে না। পরবর্তিতে খাতায় উঠিয়ে নিবো, এই মনে করে কখনো আগে টাকা দিবে না। কেননা, পরে আর মনে নাও থাকতে পারে, তখন ঐ টাকা নিজের পকেট থেকে দেয়া লাগবে।

ক্যাশিয়ার প্রতিদিনের আয়-ব্যয়ের হিসাব লিখে দেখবে যে, আজকে তার হাতে কত আছে। এটাকে বলে ডেইলি ব্যালেন্স। প্রত্যেক দিন ক্যাশ মিলাবে। কারণ যে কোন সময় মুহতামিম বা কমিটির কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে যে, ক্যাশিয়ার সাহেব! আজকে আপনার ক্যাশ ইন হ্যান্ড অর্থাৎ হাতে কত টাকা আছে? তিনি সাথে সাথে বলবেন যে, আজকে আমার হাতে এত আছে। এভাবে মাঝে মধ্যে খোঁজ খবর নিবে যে ক্যাশ ঠিক মত আছে, না ক্যাশিয়ার সাহেব ওখান থেকে ব্যক্তিগত ব্যয় নির্বাহ করছে।

৪. হিসাব রক্ষকঃ তার কাছে মাদরাসার পাকা খাতা থাকবে এবং লেজারবুক থাকবে , ক্যাশবুকে তো রশিদের মাধ্যমে যত টাকা এসেছে সবই বাম পাশে উঠে গেছে, আর সকল খরচাদি ডান পাশে উঠে এখানে কোন খাত পার্থক্য করা হয়নি। কিন্তু এগুলো যখন লেজারবুকে যাবে তখন জমার সাইড এবং খরচের সাইড উভয়টি খাত ওয়ারী লেজারে উঠবে। প্রত্যেক খাতের জন্য লেজার বুকে কয়েক পৃষ্ঠা বরাদ্দ করা থাকবে এবং পৃষ্ঠা নং সহ সূচিপত্র থাকবে।

ক্যাশিয়ার সাহেব আজকে যত টাকা জমা হয়েছে এবং যত টাকা ভাউচারের মাধ্যমে খরচ হয়েছে সেগুলোর রশিদ বহি ও খরচের ভাউচার আগামীকাল হিসাবরক্ষকের কাছে দিবেন। নিজের পার্সোনাল হিসাবের খাতা তাকে দিবে না। তাকে দেখাবেও না, এটা একেবারেই নিষিদ্ধ।

হিসাব রক্ষক সাহেব নিজে রশিদ দেখে দেখে জমার সাইড লিখবেন আর খরচের ভাউচার দেখে খরচের সাইড লিখবেন। এর পর যোগ-বিয়োগ করে ক্যাশ ইন হ্যান্ড বের করবেন। অতঃপর দু’জনে মতবিনিময় করবেন যে ভাই! আপনার ক্যাশ ইন হ্যান্ড কত? তখন ক্যাশিয়ার বলবেন আমার কাছে আজকে এত আছে। হিসাব রক্ষক বলবেন, আমারও এত আছে, উভয়ের কথা মিলে গেলে ঠিক আছে। আর যদি গড়মিল হয় তাহলে যেকোনো একজন ভুল করেছেন বলে ধরা হবে এবং উভয়ে হিসাব দ্বিতীয় বার ভালো করে মিলাবে ও ভুল ঠিক করে নিবে।

মুহতামিম বা হিসাব রক্ষকের কাছে টাকা থাকবে না। টাকা থাকবে ক্যাশিয়ারের কাছে। মোটকথা, অনুমোদন প্রদানের ক্ষেত্রে থাকবে দুই জন, ক্যাশে একজন, আর হিসাব রক্ষক হিসাবে একজন, মোট চারজন। এই চারজন লোক যদি হিসাবের কাজে জড়িত থাকে তাহলে মাদরাসার এক টাকাও কোন দিন অবৈধভাবে ব্যবহার হতে পারে না। চারজন একমত হলে টাকা মেরে নেয়া সম্ভব কিন্তু চারজন একমত হওয়া সহজ নয়। একই সাথে চারজন লোক গোমরাহ হবে না। সাধারণভাবে মাদরাসাগুলোতে যে হিসাব রক্ষক থাকে সেই ক্যাশিয়ার হয়, তারা একের ভিতর দুই করে রেখেছে। এটা করার কারণে যত সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

সারাবছর সঠিক উপায়ে হিসেব রেখে বছরের শেষে সরকার অনুমোদিত কোন অডিট ফার্ম দ্বারা হিসাব নিরীক্ষণ করিয়ে নিবে। তাহলে আর কোন দায়দায়িত্ব থাকবে না। কেউ টাকা আত্নসাতের অভিযোগ করতে পারবে না। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুক।

মোটকথা, এভাবে যদি সঠিক নিয়মে মাদরাসা পরিচালনা করে নিজের জন্য, তালিবে এলেমের জন্য এবং এলাকার লোকদের জন্য আমরা মেহনত করি, তাহলে এলাকায় দ্বীন চমকে যাবে। সকল মানুষ দ্বীনদার হয়ে যাবে, মাদরাসার মধ্যে ছাত্র সংকট ও অর্থ সংকট থাকবে না ইনশাআল্লাহ! আল্লাহ আমাদেরকে আমলের তাওফীক দান করুন ! আমীন।

-শাইখুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলবী রহ.

Loading