نحمده و نصلي علي رسوله الكريم اما بعد
আল্লাহ তা’আলার সকল প্রশংসা যে, আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সহীহ ইলম অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করেছেন এবং সঠিক বুঝ দান করেছেন৷ মুসলমানদের ইলম ও আমলের ময়দান ধ্বংস করার জন্য যুগে যুগে ইহুদী-নাসারারা চক্রান্ত করেছে এবং করে আসছে৷ ইহুদী-নাসারারা যখন দেখল তাদের সরাসরি হস্তক্ষেপ মুসলমানদের তেমন ক্ষতি করছে না, সাথে সাথে মুসলমানরা তাদের চক্রান্ত সমূহ বুঝতে পারছে তখন তারা নামধারী কিছু মুসলমানদেরকে এজেন্ট হিসেবে মুসলমানদের ঈমান-আকিদা নষ্ট করার জন্য লেলিয়ে দিলো৷ এদের মধ্যে অন্যতম একটি ইহুদিদের এজেন্ট হলো তথাকথিত গয়রে মুকাল্লিদ বা আহলে হাদিস সম্প্রদায়৷ এরা মুসলমানদের আকাইদ ও আমালের উপরে আঘাত করেছে, যে সমস্ত বিধানসমূহ বেশি বেশি সম্প্রচারের প্রয়োজন ছিল, এমনকি যেই সমস্ত বিষয়গুলি সমাজ সংস্কারে কাজে লাগবে, সেগুলো ছেড়ে শরীয়তের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়গুলো, যেগুলোর কারণে মানুষের ঈমান ও আমল নষ্ট হয়ে যাবে এই কাজগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করাই তথাকথিত আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের মৌলিক আদর্শ৷ যেমন কোন মানুষ নামাজ পড়ে না এটা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই৷ একজন মানুষের আত্মশুদ্ধি প্রয়োজন এটা নিয়ে তাদের কোন টেনশন নেই৷ তাদের টেনশন হল নামাজে কেন জোরে আমিন বলবে না!? অথচ এটা শরীয়তের বিশেষ কোনো বিষয় নয়, যদিও নামাজের মধ্যে আস্তে আমীন বলা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশেষ সুন্নতের একটি৷ তাদের আক্রমন মুসলমানদের আরেকটি সুন্নতের উপর হয়েছে, সেটি হলো মুসলমানরা নামাজে হাত কোথায় বাঁধবে? বুকের উপর? না নাভির নিচে? অথচ বুকের ওপর হাত বাধার কোন হাদীসই নেই৷ চাই সেই হাদীসটি সহীহ হোক বা জয়ীফ৷ কোন হাদিস গ্রন্থে উল্লেখ নেই বুকের উপর হাত বাধতে হবে৷ কথা হলো হাত নাভির ওপরে, নয় নিচে বাঁধবে৷ বাংলাদেশে এই ফিতনাটি বেশ কয়েক বছর হল শুরু হয়েছে৷ আমাদের আহলে হক ওলামায়ে কেরাম এটার সঠিক জবাব দিয়েছেন৷ আলহামদুলিল্লাহ বাংলাদেশে সর্বপ্রথম রদ্দে গয়রে মুকাল্লিদ কনফারেন্স সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের ব্যতিক্রমধর্মী দেওবন্দী প্রতিষ্ঠান মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী (ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার) বাংলাদেশ বসুন্ধরা ঢাকায়৷ বাংলাদেশের মুফতিয়ে আজম ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান রহঃ এর তত্ত্বাবধানে৷ যেখানে আমি দেখেছি তাদের মোকাবেলা কিভাবে করতে হবে? এটা সরাসরি প্রশিক্ষণ পর্যন্ত দেয়া হয়েছে৷ এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গাইরে মুকাল্লিদ ফিতনার ওপর সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে৷ যাই হোক ইনশাআল্লাহ আমরা এখন দেখব আসলেই কি বুকের উপর হাত বাধার কথা হাদিস আছে? এবং হাত কোথায় বাঁধতে হবে? আশাকরি সকলেই বুঝতে পারবেন ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ সকলকে বুঝার তৌফিক দান করুন, আমিন৷
নামাযে হাত বাঁধা প্রসঙ্গ
হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীর দিয়ে দুই হাত তুললেন। রাবী বলেন, দুই কান বরাবর। এরপর পরিধানের চাদর গায়ে জড়িয়ে নিলেন, এরপর ডান হাত বাম হাতের উপর রাখলেন …।
عن وائل بن حجر : أنه رأى النبي صلى الله عليه وسلم رفع يديه حين دخل في الصلاة كبر، وصف همام حيال أذينه، ثم التحف بثوبه، ثم وضع يده اليمنى على اليسرى …
-সহীহ মুসলিম ১/১৭৩
হযরত হুলব আতত্বয়ী রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ইমাম হতেন এবং তাঁর ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরতেন।
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يؤمنا فيأخذ شماله بيمينه. رواه الترمذي وقال : حديث حسن.
-জামে তিরমিযী ১/৩৪; ইবনে মাজাহ ৫৯
হযরত সাহল ইবনে সাদ রা. বলেন, লোকদেরকে আদেশ করা হত, পুরুষ যেন নামাযে ডান হাত বাম বাহুর উপর রাখে।’-সহীহ বুখারী ১/১০৪
كان الناس يؤمرون أن يضع الرجل اليد اليمنى على ذراعه اليسرى في الصلاة. قال أبو حاتم : لا أعلمه إلا ينمى ذلك إلى النبي صلى الله عليه وسلم.
হযরত জাবির রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন নামাযরত ব্যক্তির নিকট দিয়ে গমন করছিলেন, যিনি ডান হাতের উপর বাম হাত রেখে নামায পড়ছিলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত খুলে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখলেন।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৫০৯০
مر رسول الله صلى الله عليه وسلم برجل وهو يصلي قد وضع يده اليسرى على اليمنى فانتزعها ووضع اليمنى على اليسرى. قال الهيثمي في مجمع الزوائد ٢/٢۷٥ : رجاله رجال الصحيح.
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, আমি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘আমরা নবীগণ আদিষ্ট হয়েছি দ্রুত (সময় হওয়ামাত্র) ইফতার করতে, বিলম্বে (সময়ের শেষের দিকে) সাহরী খেতে এবং নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতে।’
سمعت نبي الله صلى الله عليه وسلم يقول : إنا معاشر الأنبياء أمرنا بتعجيل فطرنا وتأخير سحورنا وأن نضع أيماننا على شمائلنا في الصلاة. قال الهيثمي في مجمع الزوائد ١/ ٢۷٥: رجاله رجال الصحيح.
-সহীহ ইবনে হিববান ৩/১০১, হাদীস : ১৭৬৬; আলমুজামুল কাবীর ১১/১৫৯, হাদীস : ১১৪৮৫
হারিছ ইবনে গুতাইফ রা. বলেন, ‘আমি এটা ভুলিনি যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাম হাতের উপর ডান হাত রাখতে দেখেছি, অর্থাৎ নামাযে।’
مهما رأيت نسيت لم أنس أني رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم وضع يده اليمنى على اليسرى يعني : في الصلاة.
-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৫৬; মুসনাদে আহমদ ৪/১০৫, হাদীস : ১৬৯৬৭-৬৮, ২২৪৯৭
মোটকথা, নামাযে হাত বেঁধে দাঁড়ানো সুন্নাহ। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনেক সাহাবী তা বর্ণনা করেছেন। এ কারণে নামাযে হাত ছেড়ে দাঁড়ানো, যা মালেকী মাযহাবের কোনো কোনো ইমাম গ্রহণ করেছেন, মূল সুন্নাহ নয়।
মালেকী মাযহাবের প্রাচীন গ্রন্থ ‘‘আলমুদাওয়ানাতুল কুবরা’’য় আছে, আবদুর রহমান ইবনুল কাসিম রাহ. ইমাম মালিক রাহ. থেকে নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার বিষয়ে বর্ণনা করেছেন যে, ‘ফরয নামাযে এই নিয়ম আমার জানা নেই এবং তিনি তা অপছন্দ করতেন। তবে নফল নামাযে কিয়াম যখন দীর্ঘ হয় তখন হাত বাঁধতে বাঁধা নেই।’
قال : وقال مالك في وضع اليمنى على اليسرى في الصلاة قال : لا أعرف ذلك في الفريضة وكان يكرهه، ولكن في النوافل إذا طال القيام فلا بأس بذلك يعين به نفسه.
কিন্তু এ রেওয়ায়েত উল্লেখ করার পর সুহনূন (গ্রন্থকার) বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে ওয়াহব রাহ. সুফিয়ান ছাওরী রাহ.-এর সূত্রে একাধিক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতে দেখেছেন।
قال سحنون عن ابن وهب عن سفيان الثوري عن غير واحد من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم أنهم رأوا رسول الله صلى الله عليه وسلم واضعا يده اليمنى على اليسرى في الصلاة.
-আলমুদাওয়ানাহ ১/৭৬
ইমাম মালেক রাহ.-এর অন্য অনেক শাগরিদ তাঁর থেকে হাত বাঁধার নিয়ম বর্ণনা করেছেন। মালেকী মাযহাবের বিখ্যাত মনীষীদের অনেকেই তাঁর এই রেওয়ায়েতকেই বিশুদ্ধ ও অগ্রগণ্য বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
ইমাম মালিক রাহ.-এর ‘আলমুয়াত্তা’য় এ নিয়মই বর্ণিত হয়েছে।
‘আততাজ ওয়াল ইকলীল লিমুখতাসারিল খালীল’ কিতাবে ইমাম মালেক রাহ. থেকে হাত বাঁধার নিয়ম বর্ণনা করার পর ইবনে রুশদ মালেকীর বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘এটিই অগ্রগণ্য ও শক্তিশালী। কারণ প্রথম যুগে মানুষকে এরই আদেশ করা হত।’
ابن رشد : وهذا هو الأظهر، لأن الناس كانوا يؤمرون به في الزمان الأول.
তদ্রূপ কাযী ইয়ায মালেকী রাহ. থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আমাদের শায়খগণ ডান হাতের পাতা বাম হাতের কব্জির উপর মুঠ করার নিয়মই গ্রহণ করেছেন।’
عياض : اختار شيوخنا قبض كف اليمنى على رسغ اليسرى.
-আততাজ ওয়াল ইকলীল, আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ আলমাওওয়াক আলমালেকী (৮৯৭ হি.) মাওয়াহিবুল জালীলের সাথে মুদ্রিত ২/২৪০
ইমাম কুরতুবী মালেকী রাহ.ও (৬৭১ হি.) হাত বাঁধার রেওয়ায়েতকে অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করে বলেন, ‘এটিই সঠিক। কারণ হযরত ওয়াইল রা. ও অন্যান্য সাহাবী বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডান হাত বাম হাতের উপর রেখেছেন।’ -আলজামি লিআহকামিল কুরআনিল কারীম ২০/১৫০ এ প্রসঙ্গে মালেকী মাযহাবের বিখ্যাত মনীষী ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. (৪৬৩ হি.) শক্তিশালী আলোচনা করেছেন। তিনি হাত বাঁধার নিয়মকে শুধু অগ্রাধিকারই দেননি; বরং এর বিপরীতে ইমাম মালেক রাহ. থেকে যা কিছু বর্ণনা করা হয় তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় খন্ডনও করেছেন। তাঁর আলোচনার কিছু অংশ মূল পাঠসহ তুলে দেওয়া হল।
তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে (নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ভিন্ন কিছু বর্ণিত হয়নি এবং কোনো সাহাবী এ নিয়মের বিরোধিতা করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। শুধু আবদুল্লাহ ইবনুয যুবায়ের রা. সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়, তিনি নামাযে হাত ছেড়ে রাখতেন, তবে এর বিপরীত কথাও তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে। ইতিপূর্বে আমরা তাঁর বক্তব্য উল্লেখ করেছি যে, ‘সুন্নাহ হচ্ছে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা।’
জুমহূর তাবেয়ীন ও মুসলিম উম্মাহর আহলুর রায় ও আহলুল আছর উভয় ঘরানার অধিকাংশ ফকীহ এই নিয়মই গ্রহণ করেছেন।’
لم تختلف الآثار عن النبي صلى الله عليه وسلم في هذا الباب ولا أعلم عن أحد من الصحابة في ذلك خلافا الاشيء روي عن ابن الزبير أنه كان يرسل يديه إذا صلى وقد روى عنه خلافه مما قدمنا ذكره عنه وذلك قوله صلى الله عليه وسلم (كذا) وضع اليمين على الشمال من السنة، وعلى هذا جمهور التابعين وأكثر فقهاء المسلمين من أهل الرأي والأثر.
-আততামহীদ ২০/৭৪-৭৫
তিনি আরো বলেন, ‘ইবনুল কাসিম ছাড়া অন্যরা ইমাম মালেক রাহ. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ফরয-নফল কোনো নামাযেই হাত বাঁধতে বাধা নেই। আর এটিই তাঁরা মদীনাবাসী শাগরিদদের বর্ণনা।’
… وقال عنه (أي عن مالك) غير ابن القاسم : لا بأس بذلك في الفريضة والنافلة، وهي رواية المدنيين عنه.
-প্রাগুক্ত
এরপর কোনো কোনো তাবেয়ী থেকে নামাযে হাত ছেড়ে রাখার যে বর্ণনা পাওয়া যায় সে সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার পর তিনি বলেন, ‘এই হচ্ছে কতিপয় তাবেয়ীর (আমলের) কিছু বিবরণ। তবে তা (আলোচিত সুন্নাহর) খিলাফ ও বিরোধিতা নয়। কারণ তাদের কেউ (হাত বাঁধা) অপছন্দ করতেন এমনটা পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও তা দলীল হিসেবে গ্রহণ করা যেত না। কারণ সুন্নাহর অনুসারীদের জন্য সুন্নাহই হচ্ছে দলীল। আর যারা এর বিরোধিতা করে তাদের বিরুদ্ধেও দলীল হচ্ছে সুন্নাহ, বিশেষত যে সুন্নাহয় কোনো সাহাবীর ভিন্নমত নেই।
فهذا ما روي عن بعض التابعين في هذا الباب وليس بخلاف، لأنه لا يثبت عن واحد منهم كراهية، ولو ثبت ذلك ما كانت فيه حجة، لأن الحجة في السنة لمن اتبعها، ومن خالفها فهو محجوج بها، ولا سيما سنة لم يثبت عن واحد من الصحابة خلافها.
-প্রাগুক্ত ২০/৭৬
তিনি আরো বলেন, ‘(হাত বাধার ক্ষেত্রে) ফরয-নফলে পার্থক্য করার কোনো যুক্তি নেই, যদিও কেউ বলে থাকেন যে, হাত বাঁধার নিয়মটি নফল নামাযের ক্ষেত্রে, ফরযের ক্ষেত্রে নয়। কারণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত নফল নামায ঘরে আদায় করতেন। সুতরাং এটা যদি তাঁর ঘরের নামাযের নিয়ম হত তাহলে তা বর্ণনা করতেন তাঁর স্ত্রীগণ। কিন্তু তাঁরা এ বিষয়ে কিছুই বর্ণনা করেননি। যাঁরা বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতেন তাঁরা তাঁর নিকট রাত্রিযাপন করতেন না এবং তাঁর ঘরেও প্রবেশ করতেন না। তাঁরা তো তা-ই বর্ণনা করেছেন, যা তাঁকে করতে দেখেছেন তাঁর পিছনে ফরয নামায আদায়ের সময়।’
وكذلك لا وجه للتفرقة بين النافلة والفريضة، ولو قال قائل إن ذلك في الفريضة دون النافلة، لأن أكثر ما كان يتنفل رسول الله صلى الله عليه وسلم في بيته ليلا، ولو فعل ذلك في بيته لنقل عنه ذلك أزواجه ولم يأت عنهن في ذلك شيء، ومعلوم أن الذين رووا عنه أنه كان يضع يمينه على يساره في صلاته لم يكونوا ممن يبيت عنده، ولا يلج بيته، وإنما حكوا عنه ما رأوا منه في صلاتهم خلفه في الفرائض، والله أعلم.
-প্রাগুক্ত ২০/৭৯
হাত কোথায় বাঁধা সুন্নত?
তো এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে হাত বাঁধতেন এবং সাহাবায়ে কেরামও হাত বাঁধতেন। এখন প্রশ্ন হল, কোথায় তাঁরা হাত বাঁধতেন? মৌখিক বর্ণনায় হাত বাঁধার মূল প্রসঙ্গ যত পরিষ্কারভাবে এসেছে কোথায় বাঁধতেন তা সেভাবে আসেনি। কেন আসেনি? আসার প্রয়োজন হয়নি। কারণ সবাই হাত বাঁধছেন। কোথায় বাঁধছেন তা সবার সামনেই পরিষ্কার। কাজেই তা মুখে বর্ণনা করার প্রয়োজন হয়নি। তো যে সুন্নাহ কর্মে ও অনুসরণে ব্যাপকভাবে রয়েছে তা মৌখিক বর্ণনায় সেভাবে নেই। এ ধরনের ক্ষেত্রে পরের যুগের লোকদের জন্য সাহাবা-তাবেয়ীনের আমল ও ফতোয়া সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাঁরা ঐ সময়ের কর্ম ও অনুশীলনের প্রত্যক্ষদর্শী।
নামাযে হাত বাঁধার সুন্নাহর উপর সাহাবা-তাবেয়ীন কীভাবে আমল করেছেন-এ বিষয়ে ইমাম তিরমিযী রাহ. (২৭৯ হি.) বলেন-
والعمل على هذا عند أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم والتابعين ومن بعدهم، يرون أن يضع الرجل يمينه على شماله في الصلاة، ورأى بعضهم أن يضعهما فوق السرة، ورأى بعضهم أن يضعهما تحت السرة، وكل ذلك واسع عندهم.
অর্থাৎ আহলে ইলম সাহাবা-তাবেয়ীন ও তাঁদের পরবর্তী মনীষীগণ এই হাদীসের উপর (ডান হাত দ্বারা বাম হাত ধরা) আমল করেছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত এই ছিল যে, নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতে হবে। তাঁদের কেউ নাভীর উপর হাত রাখার কথা বলতেন, আর কেউ নাভীর নিচে রাখাকে (অগ্রগণ্য) মনে করতেন। (তবে) দুটো নিয়মই তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল।-জামে তিরমিযী ১/৩৪
মূলত এটা হচ্ছে হাত বাঁধার হাদীসসমূহের ব্যাখ্যা ও প্রায়োগিক পদ্ধতি। সাহাবা-তাবেয়ীনের যমানা থেকে এ দুটি নিয়মই চলে আসছে। পরবর্তীতে জুমহূর ফকীহ ও মুজতাহিদ ইমামগণ এ দুই নিয়ম গ্রহণ করেছেন। এভাবে উম্মাহর তাওয়ারুছ ও ব্যাপক চর্চার মাধ্যমে নামাযে হাত বাঁধার যে নিয়ম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছেছে তা উল্লেখিত হাদীসসমূহেরই ব্যবহারিক রূপ। এ কারণে পরবর্তী যুগে বিচ্ছিন্ন কোনো নিয়ম আবিষ্কার করে তাকে হাদীস শরীফের উপর আরোপ করা হাদীসের তাহরীফ ও অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। উল্লেখ্য যে, উপরে ইমাম তিরমিজী রহঃ নাভীর উপরে বা নিচে হাত বাধার কথা উল্লেখ করলেও, বুকের উপর হাত বাধার কথা উল্লেখ করেননি৷
নাভীর নিচে হাত বাঁধাই সুন্নত
উপরোক্ত দুই নিয়মের মাঝে নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়মটি রেওয়ায়েতের বিচারে অগ্রগণ্য। ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রাহ. (২৩৮ হি.) বলেছেন, ‘নাভীর নিচে হাত বাঁধা রেওয়ায়েতের বিচারে অধিক শক্তিশালী এবং ভক্তি ও বিনয়ের অধিক নিকটবর্তী।’
تحت السرة أقوى في الحديث تحت السرة أقوى في الحديث وأقرب إلى التواضع
তাবেয়ী আবু মিজলায লাহিক ইবনে হুমাইদ রাহ. (মৃত্যু : ১০০ হি.-এর পর) নামাযে কোথায় হাত বাঁধবে-এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘ডান হাতের পাতা বাম হাতের পাতার পিঠের উপর নাভীর নিচে রাখবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৬৩
এই রেওয়ায়েতের সনদ সহীহ।
সনদসহ রেওয়ায়েতটির পূর্ণ আরবী পাঠ এই –
حدثنا يزيد بن هارون قال : أخبرنا الحجاج بن حسان قال : سمعت أبا مجلز ـ أو سألته ـ قال : قلت كيف أصنع؟ قال : يضع باطن كف يمنيه على ظاهر كف شماله ويجعلها أسفل من السرة.
বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.ও (মৃত্যু : ৯৬ হি.) এই ফতোয়া দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর নাভীর নিচে রাখবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৬০
এই রেওয়ায়েতের সনদ হাসান। সনদসহ রেওয়ায়েতটির পূর্ণ আরবী পাঠ এই-
حدثنا وكيع، عن ربيع، عن أبي معشر، عن إبراهيم قال : يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة.
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশশাইবানী রাহ. (১৮৯ হি.) বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. নাভীর নিচে হাত বাঁধতেন। এরপর তিনি বলেন, ‘আমরা এই নিয়মই অনুসরণ করি এবং এটিই (ইমাম) আবু হানীফার সিদ্ধান্ত।’-কিতাবুল আছার, হাদীস : ১২১
সনদসহ রেওয়ায়েতটির আরবী পাঠ এই-
قال محمد : أخبرنا الربيع بن صبيح، عن أبي معشر، عن إبراهيم : أنه كان يضع يده اليمنى على يده اليسرى تحت السرة. قال محمد : وبه نأخذ وهو قول أبي حنيفة رحمه الله. (كتاب الصلاة، باب الصلاة قاعدا والتعمد على شيء أو يصلي إلى سترة)
প্রসঙ্গত আগেই বলা হয়েছে যে, সাহাবা-তাবেয়ীনের আমল হচ্ছে হাত বাঁধা সংক্রান্ত মারফূ হাদীসসমূহের ব্যবহারিক রূপ। এ কারণে মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ-এর সূত্রে হাত বাঁধার মরফূ হাদীস বর্ণনা করার পর এই নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন।
রেওয়ায়েতটি এই-
أخبرنا أبو حنيفة، عن حماد عن إبراهيم أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يعتمد بإحدى يديه على الأخرى في الصلاة، يتواضع لله تعالى. قال محمد : ويضع بطن كفه الأيمن على رسغه الأيسر، تحت السرة، فيكون الرسغ في وسط الكف، (كتاب الأثار، كتاب الصلاة، باب الصلاة قاعدا والتعمد على شيء أو يصلي إلى سترة)
ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে এক হাতের উপর অন্য হাত বাঁধতেন। এভাবে তিনি আল্লাহর সামনে বিনীত হতেন।’
(ইমাম) মুহাম্মাদ বলেন, ‘ডান হাতের তালু বাম হাতের কব্জির উপর রাখবে, নাভীর নিচে; সুতরাং কব্জি থাকবে হাতের তালুর মাঝে।’-কিতাবুল আছার, হাদীস : ১২০
খাইরুল কুরূন ও পরবর্তী যুগের হাদীস ও ফিকহের বিখ্যাত ইমামগণও নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়ম গ্রহণ করেছেন।
ইমাম ইবনে কুদামা হাম্বলী রাহ. (৬২০ হি.) বলেন, নামাযে কোথায় হাত বাঁধা হবে এ বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা আছে। (ইমাম) আহমদ রাহ. থেকে বর্ণিত, দুই হাত নাভীর নিচে রাখবে। এটি (হযরত) আলী রা., আবু হুরায়রা রা., আবু মিজলায রাহ., ইবরাহীম নাখায়ী রাহ., (সুফিয়ান) ছাওরী রাহ., ইসহাক (ইবনে রাহুয়াহ) রাহ. থেকে বর্ণিত।-আলমুগনী ২/১৪১
উল্লেখ্য, ইবনে কুদামা হাম্বলী রাহ. ‘আলমুগনী’তে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. থেকে মোট তিনটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন। তবে মূল মতন অর্থাৎ ‘মুখতাসারুল খিরাকী’তে শুধু নাভীর নিচে হাত বাঁধার কথাই বলা হয়েছে।
আরবী পাঠ-ويجعلهما ويجعلهما تحت سرته
‘মুখতাসারে’র ভূমিকায় লেখক ইমাম আবুল কাসিম উমার ইবনুল হুসাইন আলখিরাকী (৩৩৪ হি.) বলেছেন, ‘আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর মাযহাব অনুসারে (শরীয়তের মাসাইল) এই কিতাবে সংকলন করেছি।’
اختصرت هذا الكتاب ليقرب على متعلمه على مذهب أبي عبد الله أحمد بن محمد بن حنبل رضي الله عنه.
-আলমুগনী ১/৭-৮
শায়খ আবুল হুসাইন ইয়াহইয়া ইবনে আবুল খায়ের রাহ. (মৃত্যু ৫৫৮ হি.) বলেন, (ইমাম) আবু ইসহাক (আলমারওয়াযী) রাহ. বলেছেন, ‘এক হাত অন্য হাতের উপর নাভীর নিচে রাখবে।’-আলবায়ান ফী মাযাহিবিল ইমামিশ শাফেয়ী ২/১৭৫
উল্লেখ্য, ইমাম আবু ইসহাক আলমারওয়াযী রাহ. শাফেয়ী মাযহাবের একজন প্রসিদ্ধ মনীষী। ইমাম শাফেয়ী রাহ. নাভীর উপর (বুকের নিচে) হাত বাঁধার নিয়ম গ্রহণ করলেও আবু ইসহাক মারওয়াযী নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়মকেই অগ্রগণ্য মনে করেছেন।
ইমাম নববী রাহ. (৬৭৬ হি.) বলেন, (ইমাম) আবু হানীফা, (সুফিয়ান) ছাওরী ও ইসহাক (ইবনে রাহুয়াহ) বলেন, ‘দুই হাত নাভীর নিচে রাখবে। আমাদের (শাফেয়ী মাযহাবের) মনীষীদের মধ্যে আবু ইসহাক আলমারওয়াযী রাহ.ও তা গ্রহণ করেছেন। আর ইবনুল মুনযির তা বর্ণনা করেছেন আবু হুরায়রা, (ইবরাহীম) নাখায়ী ও আবু মিজলায রাহ. থেকে।
তিনি আরো বলেন, ‘আলী ইবনে আবী তালিব রা. থেকে দুটি রেওয়ায়েত আছে : এক. নাভীর উপর হাত বাঁধা, দুই. নাভীর নিচে হাত বাঁধা।
-আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাব ৪/৩৩০
উল্লেখ্য, জনৈক গবেষক একটি রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রাহ. নামাযে বুকের উপর হাত বাঁধার অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তার এই প্রয়াস যথার্থ নয়। কারণ হাদীস ও ফিকহের বিখ্যাত মনীষীগণ ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রাহ. সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়ম গ্রহণ করেছেন। ইবনুল মুনযির রাহ. (৩১৮ হি.) স্বয়ং ইসহাক ইবনে রাহুয়াহর দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন যে, ‘নাভীর নিচে হাত বাঁধা রেওয়ায়েতের বিচারে শক্তিশালী এবং ভক্তি ও বিনয়ের অধিক নিকটবর্তী।’
সুতরাং এখানে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। আর যে রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, তিনি বুকের উপর হাত বাঁধতেন ঐ রেওয়ায়েতেও তা নিশ্চিতভাবে বলা হয়নি। বলা হয়েছে, তিনি বিতর নামাযে বুকের উপর হাত বাঁধতেন বা বুকের নিচে।
আরবী পাঠ-
كان إسحاق يوتر بنا … ويضع يديه على ثدييه أو تحت الثديين.
আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি যে, নাভীর নিচে ও নাভীর উপরে (বুকের নিচে) দু’ জায়গায় হাত বাঁধার নিয়মই সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে ছিল। তাঁরা একটিকে অগ্রগণ্য মনে করলেও কেউ অন্যটিকে অনুসরণযোগ্য মনে করতেন। তো ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রাহ. যদি নাভীর নিচে হাত বাঁধাকে অগ্রগণ্য মনে করার পর কখনো কখনো নাভীর উপরে হাত বাঁধার নিয়ম অনুসরণ করে থাকেন তাতে আশ্চর্যের কী আছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই একটি অস্পষ্ট রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে কোনো একটি বিচ্ছিন্ন মত কারো উপর আরোপ করার অবকাশ নেই। এটি বরং আরোপকারীর দলীল-প্রমাণের দৈন্য এবং শুযূয ও বিছিন্নতাকেই প্রকটভাবে প্রকাশিত করে দেয়।
মূল আলোচনায় ফিরে আসি। এ পর্যন্ত আমরা খাইরুল কুরূন ও পরবর্তী যুগের হাদীস ও ফিকহের বিখ্যাত ইমামগণের ফতোয়া ও আমল লক্ষ্য করেছি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সাহাবা-তাবেয়ীনের যমানায় নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়ম ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়েছে, যা হাত বাঁধার মরফূ হাদীসমূহেরই ব্যাখ্যা ও ব্যবহারিক রূপ।
নাভীর নিচে হাত বাঁধা যেমন সাহাবা-তাবেয়ীনের আমল ও ফতোয়া দ্বারা প্রমাণিত তেমনি মারফূ রেওয়ায়েতের সূত্রেও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত।
নাভীর নিচে হাত বাঁধার মারফূ‘ রেওয়ায়াত সমূহ
১. হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণিত, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর নাভীর নীচে রেখেছেন।
সনদসহ রেওয়ায়েতের আরবী পাঠ এই-
حدثنا وكيع، عن موسى بن عمير، عن علقمة بن وائل بن حجر، عن أبيه قال : رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة.
-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৫১
এই বর্ণনার সনদ সহীহ। ইমাম কাসেম ইবনে কুতলূবুগা রাহ. (৮৭৯ হি.) বলেন-وهذا إسناد جيد এটি একটি উত্তম সনদ।-আততা’রীফু ওয়াল ইখবার রিতাখরীজি আহাদীছিল ইখতিয়ার-হাশিয়া শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা
উল্লেখ্য, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবার একাধিক পান্ডুলিপিতে হাদীসটি এভাবেই অর্থাৎ ةحة السرة (নাভীর নিচে) কথাটাসহ আছে। এর মধ্যে ইমাম মুরতাযা আযাবীদী-এর পান্ডুলিপি ও ইমাম আবিদ আসসিন্দী রাহ.-এর পান্ডুলিপি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম কাসিম ইবনে কুতলূবুগা রাহ., আল্লামা আবদুল কাদির ইবনে আবু বকর আসসিদ্দীকি ও আল্লামা মুহাম্মাদ আকরাম সিন্ধীর পান্ডুলিপিতেও হাদীসটি এভাবে আছে। পক্ষান্তরে অন্য কিছু পান্ডুলিপিতে এই বর্ণনায় تحة السرة (নাভীর নিচে) কথাটা নেই। এ কারণে ভারতবর্ষে মুদ্রিত মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবার পুরানো সংস্করণে এই হাদীসে تحةالسرة (নাভীর নিচে) অংশটি ছিল না। বর্তমানে মদীনা মুনাওয়ারার বিখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিস শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামার তাহকীক-সম্পাদনায় মুসান্নাফের যে মুদ্রণ পাঠক-গবেষকদের কাছে পৌঁছেছে তাতে হাদীসটি تحة السرة (নাভীর নিচে) অংশসহ রয়েছে। কারণ শায়খের সামনে প্রথমোক্ত পান্ডুলিপি দুটিও ছিল। এ বিষয়ে
বিস্তারিত আলোচনার পর শায়খ বলেন-
ومن نقل الحديث من إحدى النسخ الأربع خ. ظ. ن. ش. التي ليست فيها هذه الجملة : معذور في عدم إثبات هذه الزيادة، ولكنه ليس معذورا في نفي ورودها، ومن نقله عن إحدى النسختين اللتين فيهما هذه الزيادة هو معذور في إثباتها، بل واجب عليه ذلك ولا يجوز لها حذفها فعلى م التنابز والتنابذ؟
উৎসাহী আলিমগণ শায়খের পূর্ণ আলোচনা মুসান্নাফের টীকায় দেখে নিতে পারেন।
উল্লেখ্য, যারা মুআম্মাল ইবনে ইসমাইলের মুনকার রেওয়ায়েত অবলীলায় গ্রহণ করেন তাদের তো এই রেওয়ায়েত গ্রহণে দ্বিধা থাকার কথা নয়। কারণ
এক. এই রেওয়ায়েতের সনদ ইবনে খুযায়মার ঐ রেওয়ায়েতের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।
দুই.ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে অন্য সূত্রে বর্ণিত কিছু রেওয়ায়েতেও এর বেশ সমর্থন পাওয়া যায়। ইমাম তবারানী রাহ. হুজর আবুল আম্বাসের সূত্রে ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর এই বিবরণ উল্লেখ করেছেন। তাতে আছে, ‘তিনি তার ডান হাত বাম হাতের উপর রাখলেন এবং তা রাখলেন পেটের উপর।’
সনদসহ রেওয়ায়েতটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا أبو مسلم الكشي ثنا حجاج بن نصير ثنا شعبة عن سلمة بن كهيل قال : سمعت حجرا أبا العنبس يحدث عن وائل الحضرمي أنه صلى مع رسول الله صلى الله عليه وسلم …، ثم وضع يده اليمنى على اليسرى وجعلها على بطنه.
-আলমুজামুল কাবীর ২২/৪৪, হাদীস : ১১০
তেমনি সুনানে দারেমী ও আলমু’জামুল কাবীর তবারানীতে আবদুল জাববার ইবনে ওয়াইলের সূত্রে ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর যে বিবরণ বর্ণিত হয়েছে, তাতে আছে, ‘তিনি ডান হাত বাম হাতের উপর কব্জির কাছে রাখলেন।’ সনদসহ রেওয়ায়েতটির আরবী পাঠ এই-
قال الإمام الدارمي في السنن (باب وضع اليمين على الشمال في الصلاة) : أخبرنا أبو نعيم، ثنا زهير، عن أبي إسحاق، عن عبد الجبار بن وائل، عن أبيه قال : رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم يضع يده اليمنى على اليسرى قريبا من الرسغ. انتهى
ورواه الطبراني بطريق عبدان بن أحمد، ثنا عمرو بن عثمان الحمصي، ثنا إسماعيل بن عياش، عن يونس بن أبي إسحاق عن أبي إسحاق به.
-সুনানে দারেমী ১/২২৮; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী ২২/২৫, হাদীস : ৫২
এই রেওয়ায়েতগুলো সামনে রাখলে বোঝা যায়, আসিম ইবনে কুলাইবের সূত্রে ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর যে বিবরণ যাইদা ইবনে কুদামা বর্ণনা করেছেন, যাতে ‘ডান হাত বাম হাতের পাতার পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর রাখার কথা আছে, তার অর্থ ‘বাহু বাহুর উপর’ রাখা নয়; বরং ডান হাতের পাতা এমনভাবে রাখা যে, তা বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর কিছু অংশের উপর থাকে। এ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব বুকের উপর হাত বাঁধার মতটি পর্যালোচনা করার সময় ইনশাআল্লাহ।
নাভীর নিচে হাত বাঁধার বিষয়ে জয়ীফ সনদে বর্ণিত কিছু রেওয়ায়েতও আছে। তবে রেওয়ায়েতগুলোর বিষয়বস্ত্ত উপরে বর্ণিত হাদীস, আছার ও আমলে মুতাওয়ারাছ দ্বারা সমর্থিত।
২. হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘সুন্নাহ হচ্ছে নামাযে হাতের পাতা হাতের পাতার উপর নাভীর নিচে রাখা।’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৮৭৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৭৫৬; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৬৬
সনদসহ রেওয়ায়েতটির পূর্ণ আরবী পাঠ এই-
حدثنا محمد بن محبوب، حدثنا حفص بن غياث، عن عبد الرحمن بن إسحاق، عن زياد بن زيد، عن أبي جحيفة أن عليا رضي الله عنه قال : السنة وضع الكف على الكف في الصلاة تحت السرة.
قال المزي في تحفة الأشراف ٨/٤٥٨، هذا الحديث في رواية ابي سعيد بن الأعرابي، وابن داسة وغير واحد عن أبي داود، ولم يذكره أبو القاسم.
৩. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ‘নামাযে হাতের পাতাসমূহ দ্বারা হাতের পাতাসমূহ নাভীর নীচে ধরা হবে।’
সনদসহ রেওয়ায়েতটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا مسدد، حدثنا عبد الواحد بن زياد، عن عبد الرحمن بن إسحاق الكوفي، عن سيار أبي الحكم، عن أبي وائل قال : قال أبو هريرة رضي الله عنه : أخذ الأكف على الأكف في الصلاة تحت السرة.
-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৭৫৮, তাহকীক : শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ; তুহফাতুল আশরাফ, হাদীস : ১৩৪৯৪
এই দুই রেওয়ায়েতের সনদে আবদুর রহমান ইবনে ইসহাক নামক একজন রাবী আছেন। ইমাম তিরমিযী রাহ. তার সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসকে হাসান বলেছেন। দেখুন : জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩৪৬২; আরো দেখুন : হাদীস ২৫২৭
আবদুর রহমান ইবনে ইসহাকের সূত্রে হাদীসটি (২৫২৬) বর্ণনা করার পর ইমাম তিরমিযী বলেন, কোনো কোনো মনীষী এই আবদুর রহমান ইবনে ইসহাকের স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন। আরবী পাঠ-
ا هذا حديث غريب وقد تكلم بعض أهل العلم في عبد الرحمن هذا من قبل حفظه وهو كوفي، وعبد الرحمن بن إسحاق القرشي مديني وهو أثبت من هذا. انتهى
উল্লেখ্য, শায়খ আলবানী রাহ.ও আবদুর রহমান ইবনে ইসহাকের সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসকে শাওয়াহেদের (অন্যান্য বর্ণনার সমর্থনের) কারণে সিলসিলাতুস সহীহায় উল্লেখ করেছেন। দেখুন : সিলসিলাতুস সহীহা হাদিস
৪. আনাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘তিনটি বিষয় (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর) নবী-স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত: ইফতারে বিলম্ব না করা, সাহরী শেষ সময়ে খাওয়া এবং নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর নাভীর নিচে রাখা।’
ثلاث من أخلاق النبوة : تعجيل الأفظار، وتأخير السحور، ووضع اليد اليمنى على اليسرى في الصلاة تحت السرة.
-আলমুহাল্লা ৩/৩০; আলজাওহারুন নাকী ২/৩১
উল্লেখ্য, ইবনে হাযম রাহ. (৪৫৬ হি.) তাঁর নামাযে হাত বাঁধার আলোচনায় নাভীর নিচে হাত বাঁধার একটি মারফূ হাদীস ও একটি আছর উল্লেখ করেছেন। তবে সেগুলোর সনদ উল্লেখ করেননি।
পক্ষান্তরে এ আলোচনায় বুকের উপর হাত বাঁধার একটি রেওয়ায়েতও উল্লেখ করেননি, না সনদসহ না সনদ ছাড়া। তদ্রূপ হাত বাঁধার নিয়ম উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘মুস্তাহাব হল, নামাযী তার ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রাখবে।’
ويستحب أن يضع المصلي يده اليمنى على كوع يده اليسرى في الصلاة، في وقوفه كله فيها.
-আলমুহাল্লা ৩/২৯
আসল কথা হলো :
নামাযে হাত বাঁধা সুন্নাহ। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনেক সাহাবী রাঃ তা বর্ণনা করেছেন। এই সুন্নাহর ব্যবহারিক রূপ খাইরুল কুরূনে কী ছিল তা সাহাবা-তাবেয়ীনের আমল ও ফতোয়া এবং সে যুগ থেকে চলে আসা ‘আমলে মুতাওয়ারাছ’ দ্বারা প্রমাণিত, যা ইবাদত-বন্দেগীর সঠিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ও শক্তিশালী সূত্র। এ সূত্রে নামাযে হাত বাঁধার দু’টি নিয়ম পাওয়া যায় : নাভীর নিচে হাত বাঁধা ও নাভীর উপর (বুকের নীচে) হাত বাঁধা। দু’টো নিয়মই আহলে ইলম সাহাবা-তাবেয়ীনের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল, যা ইমাম তিরমিযী রাহ. জামে তিরমিযীতে বর্ণনা করেছেন। তবে রেওয়ায়েতের বিচারে নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়মটি অগ্রগণ্য। ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রাহ. তা পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন।
খাইরুল কুরূন ও পরবর্তী যুগের হাদীস-ফিকহের বড় বড় ইমাম এই নিয়ম গ্রহণ করেছেন। এঁদের মধ্যে ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম সুফিয়ান ছাওরী, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপরন্তু বেশ কিছু মরফূ হাদীসেও নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়ম বর্ণিত হয়েছে।
সুতরাং এটি নামাযে হাত বাঁধার মাসনূন তরীকা। এ সম্পর্কে দ্বিধা ও সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।
তবে উল্লেখ্য যে, উপরক্ত পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতি যেমন বুকের উপর হাত বাধা, সম্পুর্ন সুন্নাহ বিরোধী ও দ্বীন অবমাননার শামিল, ইহা অবশ্যই পরিতায্য৷
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সুন্নত বুঝে সুন্নতের উপর আমল করার তৌফিক দান করুন, আমিন৷