بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ۔ اَلرَّحْمٰنُ ۙ﴿۱﴾ عَلَّمَ الْقُرْاٰنَ ؕ﴿۲﴾ خَلَقَ الْاِنْسَانَ ۙ﴿۳﴾
وعن إبراهيم بن عبد الرحمن العذري قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : يحمل هذا العلم من كل خلف عدوله ينفون عنه تحريف الغالين وانتحال المبطلين وتأويل الجاهلين.
হামদ ও সালাতের পর- বাংলাদেশের প্রাচীনতম, বিশুদ্ধতম এবং বৃহত্তম মাদ্রাসা দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী। এই মাদ্রাসার বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে আজকের এই মোবারক মহাসমাবেশে আমরা সমবেত হয়েছি। তাই মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে কিছু কথা আপনাদের খেদমতে আরয করতে চাই। যেহেতু, বর্তমান পরিস্থিতিতে মাদ্রাসা শিক্ষা বহুমুখী ষড়যন্ত্রের শিকার, মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে বহুমুখী অপবাদ রটানো হচ্ছে। তাই যে সমস্ত সরল মুসলমান অপবাদ রটনাকারীদের মিথ্যাচারে সন্দিহান হয়ে পড়েন, তারা যেন এই অপবাদ রটানাকারীদের চক্রান্ত থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে পারেন, সেই লক্ষ্যে আমি মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে কয়েকটি কথা আপনাদের খেদমতে আরজ করতে চাই।
উপমহাদেশের ইতিহাসে তিন প্রকার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সন্ধান পাওয়া যায়। এক প্রকার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দ্বিতীয় প্রকার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ১৭৮১ খ্রিঃ থেকে চালু হয়েছিল। তৃতীয় প্রকার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ১৮৬৬ খ্রিঃ থেকে চালু হয়েছে।
বিলুপ্ত হওয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা ছিল, ঐ সময়ে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের আগে মোগল শাসকদের আমলে ভারত উপমহাদেশে প্রায় ১২ লক্ষ মাদ্রাসা ছিল। সবগুলো মাদ্রাসার ব্যয়ভার বহন করার জন্য উপযোগী মাদ্রাসার নামে ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল। মাদ্রাসার নিজস্ব ওয়াকফ সম্পত্তির আয়ের দ্বারা মাদ্রাসার বছর ব্যাপী ব্যয়ভার বহন করা হতো। ইংরেজরা বাণিজ্যের বাহানায় আমাদের উপমহাদেশে প্রবেশ করতঃ দেশের শাসন ক্ষমতা জবর দখল করে নেওয়ার পর মাদ্রাসার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়। যার ফলে ইংরেজ শাসন আমলে উপমহাদেশের ১২ লক্ষ মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়।
তারপর, উপমহাদেশে যখন ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ভারতের সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন শাহ্ ওলী উল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ.)। তার সুযোগ্য বড় ছেলে ছিলেন শাহ্ আবদুল আজিজ (রাহ.)। শাহ্ আবদুল আজিজ (রাহ.)এর একজন কৃতি ছাত্র ছিলেন মোল্লা মাজেদুদ্দীন (রাহ.)। তিনি কলিকাতার বাসিন্দা ছিলেন। কলিকাতা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা ছিল। কলিকাতার মুসলমানদের অনুরোধে মোল্লা মাজেদুদ্দীন (রাহ.) ইংরেজ সরকারের কাছে সরকারি খরচে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। সে আবেদন মঞ্জুর করে তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্ণর লর্ড ওয়্যারেন হেস্টিংস ১৭৮১ খ্রীস্টাব্দে কলিকাতায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দেন। সেই মাদ্রাসাকে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা নামে নামকরণ করা হয়। আর এটাই আমাদের উপ মহাদেশের সর্বপ্রথম আলীয়া মাদ্রাসা।
মোল্লা মাজেদুদ্দীনের মতো বুযূর্গ লোক কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার সাথে জড়িত থাকার ফলে একসময়ে শাহ্ আবদুল আজিজ (রাহ.) যখন ইংরেজ সরকারের কবল থেকে দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করা ফরয ঘোষণা দিলেন, তখন সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে উপমহাদেশের সমস্ত আলেম-ওলামা এবং সর্বস্তরের জনসাধারণ অংশ গ্রহণ করেন। সেই সূত্রে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা পড়–য়ারাও ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজ সরকার আলিয়া মাদ্রাসাকে শায়েস্তা করার জন্য কয়েকটা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রথম ব্যবস্থা হিসেবে কলিকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে একাধারে ২৬ জন প্রিন্সিপাল নিযুক্ত করা হয় খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে। উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে যত আলিয়া মাদ্রাসা আছে, তার উৎপত্তি কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকেই।
আচ্ছা বলুন তো, কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা খ্রিস্টানদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, না মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হলে দেখুন- প্রথম নম্বর প্রিন্সিপাল খ্রিস্টান, দ্বিতীয় নম্বর প্রিন্সিপাল খ্রিস্টান, তৃতীয় নম্বর প্রিন্সিপাল খ্রিস্টান; এভাবে একাধারে ২৬ জন প্রিন্সিপাল নিযুক্ত করা হয় খ্রিস্টান। এবার ভাবুন তো, মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল যদি খ্রিস্টান হয়, সেই মাদ্রাসার লেখা-পড়ার দশা কী হতে পারে?
এরপর দ্বিতীয় ব্যবস্থা হিসেবে ইংরেজ সরকার কলিকতা আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকায় আঘাত হানে। যেমন প্রতিষ্ঠার পর এখানে হাদীসের মিশকাত শরীফ, তাফসীরে বায়যাবী শরীফ পাঠ্য তালিাকায় অর্ন্তভুক্ত ছিল। কিন্তু কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্ররা সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার কারণে তখন ইংরেজ সরকার কলিকতা আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাস থেকে মিশকাত শরীফ এবং তাফসীরে বায়যাবী শরীফ বাতিল করে দেয়। মুসলমানদের ছেলে-মেয়েরা ইসলামের যাই কিছু শিখুক অন্তত আল্লাহর কুরআনের তাফসীর, নবীর হাদীস শেখার সুযোগ যেন না পায়, তার ব্যবস্থা কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ইংরেজ সরকার করে দিল।
তিন নম্বর ব্যবস্থা- এক পর্যায়ে ইংরেজ সরকার আইন পাস করে, যেসব ছাত্র আরবী বা ফার্সী ভাষা মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করবে, এরা সরকারীভাবে মূর্খ বলেই গন্য হবে। এই আইন পাশ করে নেওয়ার মাধ্যমে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা পড়ুয়াদেরকে অশিক্ষিত, মূর্খ সাব্যস্ত করে।
এদিকে ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধ দিনকে দিন তীব্র হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকার আরো কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো- (১) মুসলমানরা কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করে আলেম হয়। কাজেই মুসলিম সন্তানরা যাতে আলেম হতে না পারে, সে জন্য মূদ্রিত সমূদয় কুরআন শরীফ ধ্বংস করে দিতে হবে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ইংরেজ সরকার ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছরে লক্ষ লক্ষ কুরআন শরীফের মূদ্রিত কপি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিল। (নাঊযুবিল্লাহ)। আর পবিত্র কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করে যারা আলেম হয়ে গিয়েছিলেন, এ রকম ১৪ হাজার আলেমকে পর্যায়ক্রমে ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই তিন বছরে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। এভাবেই মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা যুদ্ধকে বানচাল করে দেওয়ার জন্য ইংরেজ সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
ইতিহাসের এই অংশটুকু বুঝে থাকলে এবার আপনারা একটু দয়া করে বলুন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার মূলে আবেদনকারী মোল্লা মাযেদুদ্দীনের মতো বুযুর্গ থাকলেও, মোল্লা মাযেদুদ্দীনের প্রিন্সিপালের দায়িত্বে পরিচালিত হতো আলিয়া মাদ্রাসা, নাকি ইংরেজ কর্তৃক নিয়োগকৃত খ্রিস্টান প্রিন্সিপালের দায়িত্বে পরিচালিত হতো? এভাবে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রিক আলী মাদ্রাসাসমূহ থেকে ইংরেজ সরকার মৌলিক ইসলামী শিক্ষাকে উচ্ছেদ করে দেয়।
এ পর্যায়ে ইতিহাসের বাস্তবতা আপনারা অনুধাবন করতে পারলে বলুন, ঠিক এই মুহূর্তে মাদ্রাসার নতুন কোনো সংস্কারের অপরিহার্যতা দেখা দিল কি-না? কারণ, এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয় বুঝেছেন যে, তখন কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা কেবল সাইনবোর্ডেই মাদ্রাসা নামে অবশিষ্ট ছিল, দ্বীনি শিক্ষার কিছুই তখন আর সেখানে ছিল না। এমন প্রেক্ষাপটে সেই সংস্কারের কাজে এগিয়ে আসলেন উপমহাদেশের আরেকজন কৃতি সন্তান আল্লামা কাসেম নানুতুভী (রাহ.)।
সর্বপ্রথম কাসেম নানুতুভী (রাহ.)এর কিছু পরিচয় আমাদের জেনে নেয়া দরকার। তাঁর শিক্ষাগত পরিচয়, বংশগত পরিচয় এবং রাজনৈতিক পরিচয়।
কাসেম নানুতুভী (রাহ.)এর শিক্ষাগত পরিচয় হল- তিনি ছিলেন দিল্লীর সুপ্রসিদ্ধ আলেম হযরত মাওলানা মামলুক আলী (রাহ.)এর ছাত্র। মাওলানা মমলুক আলী (রাহ.) ছিলেন শাহ্ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ.)এর ছাত্র। শাহ্ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ.) ছিলেন শাহ্ ওলী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ.)এর প্রথম ছেলে। শাহ্ ওলী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ.) ছিলেন হযরত উমর ফারুক (রাযি.)এর বংশধর।
কাসেম নানুতুভীর বংশগত পরিচয় হলো- তিনি নিজে ছিলেন সরাসরি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.)এর বংশের। কাসেম নানুতুভীর রাজনৈতিক পরিচয় হলো ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের যত জায়গায় মুক্তিযুদ্ধ হয়, এর মধ্যে ১৮৫৭ সালে শামেলির প্রান্তরে ইংরেজ বিরোধী যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি ছিলেন কাসেম নানুতুভী (রাহ.)। এসব ইতিহাস জানা থাকলে এটা সহজেই বুঝতে পারবেন যে, এই কাসেম নানুতুভী (রাহ.) উপমহাদেশের সর্বপ্রথম কওমী মাদ্রাসার ফাউন্ডার তথা ভিত্তি স্থাপনকারী ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়টা আমাদের বর্তমান সমাজের কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের জানা থাকলে তাদের মানসিক সংকীর্ণতা আর থাকবে না, তাদের মন হবে বিশাল প্রশস্ত।
এর মধ্যে হযরত কাসেম নানুতুভী (রাহ.) কয়েকজন অনুসঙ্গি নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেন। ইতিহাসের এই অংশটা বুঝে থাকলে বলুন, তখনকার পরিস্থিতির বাস্তবতায় মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের অপরিহার্যতা ছিল কিনা? তার জ্বলন্ত প্রমাণ কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার দুর্দশা। আলীয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজ সরকারের হস্তক্ষেপে লক্ষ্যচ্যুত হওয়ায় প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা বলে তখন আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। যে কারণে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের অপরিহার্যতা ছিল তখনকার সময়ের জোর দাবী। ইসলামী শিক্ষার দুর্দিনে সেই সংকটময় মহূর্তে জাতির সামনে এগিয়ে আসলেন জাতির মহাপুরুষ হযরত আবু বকর (রাযি.)এর বংশধর আল্লামা কাসেম নানুতুভী (রাহ.)। তিনি যে সমস্ত অনুসঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসলেন এ মহান কাজে, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মাওলানা রফিউদ্দীন (রাহ.)।
মাওলানা রফিউদ্দীন একদিন স্বপ্নে দেখেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর হাতের লাঠি মোবারক দ্বারা ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ নামক জনপদের এক জায়গায় রেখা অংকন করে দিলেন এবং বলে দিলেন, তোমাদের পরিকল্পিত মাদ্রাসার ঘর আমার অংকিত রেখায় রেখায় নির্মাণ করবে। ঘুম ভাঙার পরে সরেজমিনেও স্বপ্নে দেখা রাসূলের লাঠি মোবারকের দেওয়া দাগ পাওয়া গেলো। সেই দাগে দাগে উপমহাদেশে সর্বপ্রথম কওমী মাদ্রাসা দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসা ১৮৬৬ খ্রীস্টাব্দে আল্লামা কাসেম নানুতুভী (রাহ.)এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পর্যায়ে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে, উপমহাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলির প্রথম বাহ্যিক প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যদিও আমরা হযরত কাসেম নানুতুভী (রাহ.)কে দেখতে পাই, কিন্তু উপমহাদেশের কওমি মাদ্রাসাসমূহের আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) স্বয়ং। এই পয়েন্টটা স্মরণে রাখলে সামনের কথাগুলো বুঝতে সহজ হবে। উপমহাদেশের সর্বপ্রথম কওমি মাদ্রাসা ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ নামক বস্তিতে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং এই উপমহাদেশের কওমী মাদ্রাসা গুলোকে নানা রকম মিথ্যা অপবাদ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এগুলো কোনো জড়বাদি মানুষের প্রতিষ্ঠিত নয়। এগুলো স্বয়ং আল্লাহর নবী রাসূলুল্লাহ (সা.)এর আধ্যাত্মিক তাওয়াজ্জুহের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর রাসূলের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের বাতি নিভিয়ে দেওয়ার জন্য যদি কেউ ফুঁ মারে, তার মুখ পুড়ে যায়; যার ঐতিহাসিক বহু প্রমাণ আছে।
এখানে এসে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বপ্নযোগে রেখা টেনে দিলেন। সে রেখা বরাবর সর্বপ্রথম উপমহাদেশের কওমী মাদ্রাসার ঘর বানানো হয়, কথাটা কোনো মনগড়া বানানো কথা, না ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে?
এর জবাবে বলতে চাই, এটি কারো মনগড়া বানানো কথা নয়। আল্লামা সৈয়দ মাহবুব রেজভী (রাহ.)এর কয়েক হাজার পৃষ্ঠা বিশিষ্ট্য উর্দূ ভাষায় লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘তারীখে দারুল উলূম দেওবন্দ’। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক এর বাংলা সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে। সে বাংলা সংস্করণের ভূমিকাতেও স্বপ্নযোগে রাসূল (সা.)এর লাঠি মোবারক দ্বারা যে রেখা টেনে দিয়েছিলেন, সেই দাগ টানা রেখায় রেখায় সর্বপ্রথম কওমী মাদ্রাসার ঘর নির্মাণের কথা পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ আছে। সুতরাং তথ্যটা মনগড়া উদ্ভাবিত, নাকি ঐতিহাসিক তথ্য।
এ পর্যায়ে আবার প্রশ্ন জাগতে পারে যে, মুহাম্মদ (সা.) দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসার ভিত্তিস্থলের স্থান নির্ধারনি রেখা টেনে দেওয়ার জন্য যদি দেওবন্দ আসতে পারেন, তাহলে আমাদের মীলাদুন্নবী, জশনে জুলুস ইত্যাদিতে আসতে পারবেন না কেন?
এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে বলতে চাই, মদীনার রওজা শরীফে শায়িত নবী দেওবন্দের মাটিতে রেখা টেনে দেওয়ার জন্য যদি নিজে আসতে হয়, তাহলে নবীর বুযুর্গী প্রমাণিত হবে, নাকি না এসেই যদি স্বপ্ন যোগে রেখা পৌঁছে দিতে পারেন, তাহলে বুযুর্গী হয়? সুতরাং দাগ দেওয়ার জন্য নবী এসেছিলেন বললে নবীর বুযুর্গী মানা হয় না। আর বুযুর্গী মানলে দাগ দেওয়ার জন্য এসেছিলেন বলা চলে না। যেমনভাবে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশের চন্দ্রকে আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করেছিলেন শুনেছেন তো? নবীর আঙ্গুলের ইশারায় চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়েছিল কিনা? অবশ্যই চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। যে নবী জমিনে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করলে আকাশের চন্দ্র দুই টুকরা হতে পারে, সে নবী রওজা শরীফে থেকে ইশারা করলে দেওবন্দের মাটিতে কি রেখা অঙ্কিত হতে পারে না? অবশ্যই পারে। সুতরং এটাও অবান্তর কথা নয়, অবাস্তব কথা নয়। তারপরও যদি কেউ এক ঘুঁয়েমি করে নবীর বুযূর্গীকে এড়িয়ে একথা বলতে চায়, মাদ্রাসার ঘর নিমার্ণের রেখা অঙ্কনের জন্য যদি নবী দেওবন্দে অসতে পারেন, তাহলে আমাদের মীলাদ শরীফেও নবী আসেন, আমাদের জশনে জুলুসেও নবী আসেন। তাহলে আমি বলবো, আমরা কেনেদিন এই দাবি করিনি করবও না যে, মাদরাসার ঘর নির্মাণের দাগ দেওয়ার জন্য নবী দেওবন্দে এসেছিলেন। কারণ, এটা বললে নবীর বুযুর্গী মানা হয় না। কিন্তু তোমরা যারা বলো, নবী তোমাদের মীলাদ শরীফে আসেন, নবী তোমাদের জাশনে জুলুসে, মীলাদুন্নবীতে আসেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, নবী আসলে তোমরা দেখ কি, দেখ না? যদি বলো- নবী আসেন কিন্তু তোমরা দেখ না, তাহলে নিশ্চয় তোমাদের চোখে দোষ আছে। আর যদি বলো- নবী আসেন তোমরা দেখ, তাহলে তোমাদের আশেপাশে যারা থাকেন তারা কেন দেখে না? তাহলে নিশ্চয় তোমরা মিথ্যাবাদী।
এই সমস্ত প্রশ্নের জওয়াব দিতে না পেরে তারা বলেন, বাস্তবেই মীলাদ শরীফ, জুলুসে নবী আসেন। তবে তারাই নবীকে দেখতে পায়, যাদের অন্তরে নবীর প্রতি মুহাব্বত আছে। আর যাদের অন্তরে নবীর মুহাব্বত নাই তারা নবী আসলেও দেখতে পায় না।
তাদের এই দাবী বাস্তবিক হতে পারে, নাকি চাতুরিপূর্ণ? আমি যদি একটু সময়ের জন্য মেনেও থাকি এই দাবী, তাহলে এর পরিণতি কী দাঁড়ায়, এটা অবশ্যই বুঝার মতো বিষয়।
আহলে সুন্নাত ওয়ালা জামাতের আক্বিদা বিষয়ে একটি কিতাব আছে, বাংলাদেশের সমস্ত কওমী মাদ্রাসায় পাঠ্য তালিকাভুক্ত এবং সমস্ত আলীয়া মাদ্রাসায়ও পাঠ্য তলিকাভুক্ত। কিতাবটির নাম “শরহে আকাইদে নাসাফী”। এই কিতাবের অনেক ব্যাখ্যা গ্রন্থও আছে। এর একটা ব্যাখ্যা গ্রন্থের নাম ‘নিবরাস’ । নিবরাসের শুরুতে এবং শেষে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লা (সা.)এর সাহাবী কাকে বলা হবে, তার স্পষ্ট সঙ্গা ও নীতি বর্ণনা করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, যে মুমিন মুসলমান নবীকে দেখেন, অথবা যে মুমিন মুসলমানকে নবী দেখেন, সেই মুমিন মুসলমানকে এক বচনে সাহাবী আর বহুবচনে সাহাবা বলা হয়।
এবার আপনারা যারা বলেন, মীলাদ শরীফে নবী আসেন, জশনে জুলুসে নবী আসেন, যদি সত্য বলেন যে নবী আসেন কিন্তু আমি নবীকে দেখি না, তাহলে আপনাদের চোখে দোষ আছে। কিন্তু আমার নবীর চোখে কোনো দোষ নাই, তিনি অবশ্যই আপনাদেরকে দেখবেন। তখন আপনারা কি হবেন? তখন আপনাদের দাবী মতে আপনারা সাহাবী!
এবার শুনুন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদাহ মতে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর যে কোন একজন সাহাবীর মর্যাদা আদম (আ.) থেকে কিয়ামত পর্যন্ত দুনিয়াতে যত নবী এসেছিলেন, সমস্ত নবীর উম্মতে যত ওলী আওলিয়া ছিলেন, সমস্ত ওলী আওলীয়ার চেয়ে মহানবী (স.)এর একজন সাহাবীর মর্যাদা শ্রেষ্ঠ। যদি সাহাবীর এই মর্যাদা বিশ্বাস করতে পারেন, তাহলে আপনি খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত হতে পারেন। মুহাম্মদ (সা.)এর যে কোনো একজন সাহাবীর মর্যাদা সারা দুনিয়ার সমস্ত ওলী আওলীয়ার চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব রাখে। যারা সাহাবীদের এই উত্তম মর্যাদায় বিশ্বাস করতে পারে না, এরা খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত হতে পারে না। এরা সুন্নী দাবি করলে হবে সুন্নী নামের ভেজাল।
মুহতারাম হাজেরীন!
হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো মুমিন মুসলিমকে দেখলে, সেই মুমিন মুসলিম কী হয়? সাহাবী হয়ে যায়। আর নবীর একজন সাহাবীর মর্যাদা সারা দুনিয়ার সমস্ত ওলী আওলীয়ার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনারা এতদিন যাবৎ বলেন না কেন- নবী আমাদের মীলাদ শরীফে এসেছিলেন, আমাদেরকে দেখেছিলেন। কাজেই আমরা যারা মীলাদ শরীফ পড়ি, আমরা সবাই ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী, খাজা বাহারুদ্দীন (রাহ.)এর চেয়েও শ্রেষ্ঠ। অন্যথায় বলুন- আমাদের জাশনে জুলুসে নবী আসলেও, আমাদেরকে দেখলেও আমরা সাহাবী হতে পারি নাই। আমরা কোনটাকে আপনাদের বক্তব্য ধরে নেব, আপনারাই ঠিক করে দিন।
যদি সাহাবী হয়ে থাকেন, তবে বলেন না কেন? আর যদি সাহাবী না হন, তবে কান পেতে শুনে রাখুন! যে নবীকে যারা দেখেছে অথচ সাহাবী হতে পারলা না, সে ব্যক্তি মুমিন মুসলমান না, সে বেঈমান। কোন পথে যাবেন, পথ ঠিক করুন।
বেঈমানকে নবী দেখলেও সে সাহাবী হয় না। এ কারণে আবু যেহেল সাহাবী হতে পারে নাই। আপনারাই বলুন, আবু লাহাবকে নবী দেখেছিলেন? অবশ্যই দেখেছিলেন। কিন্তু আবু লাহাব সাহাবী হতে পেরেছিল? পারে নাই। কেন আবু লাহাব সাহাবী হতে পারলো না? কারণ, নবী দেখলেও বেঈমান সাহাবী হয় না, নবী বেঈমানদারকে দেখলে লাহাবী হয়। আপনাদের মীলাদুন্নবীতে নবী আপনাদেরকে দেখলেন, জাশনে জুলুসে এসে আপনাদেরকে দেখলেন। অথচ আপনারা সাহাবী হতে পারলেন না? তাহলে বুকে হাত দিয়ে বলুন, আপনারা সাহাবায়ে কেরামের মতো, নাকি আপনাদের দাবী আবু যেহেলের মতো?
দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকাকে তো আপনারা অবশ্যই চিনেন। পত্রিকাটিতে বাংলাদেশের বিদআতিদের যত খবর ছাপা হয়, বাংলাদেশের আর কোন পত্রিকায় বিদআতিদের এত খবর ছাপা হয় না। এই ইনকিলাব পত্রিকায় গত মঙ্গলবারে ৩য় পৃষ্ঠায় লিখেছে, ঈদে মীলাদুন্নবী এবং জশনে জুলুসের বিরোধীতা যারা করে, এরা শয়তানের অনুসারী। কারণ নবীর জন্মে অসন্তুষ্ট ছিল শুধু শয়তান। সুতরাং, যারা মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠানের জন্য সন্তুষ্ট নয়, জাশনে জুলুসের জন্য সন্তুষ্ট নয়, তারাও শয়তান। (নাউযুবিল্লাহ)।
আমি এই ব্যাপারে কোন পর্যালোচনা করবো না। আমি শুধু মীলাদুন্নবীতে যারা সন্তুষ্ট ছিল, তাদের একজনের ইতিহাস বলবো।
বলুন নবীর মিলাদুন্নবী অর্থ কি? নবীর জন্ম। কোন মাসে হয়েছিল? কি বারে হয়েছিল? প্রসিদ্ধ মতে কোন তারিখে হয়েছিল? প্রসিদ্ধ মতে ১২ রবীউল আওয়াল সোমবারে মহানবী (স.)এর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নবীর জন্মগ্রহণের সাথে সাথে আবু লাহাবের দাসী আবু সুয়াইবা আবু লাহাবকে নবীর জন্মের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আবু লাহাব খুশী হয়ে দাসী আবু সুয়াইবাকে দুই আঙ্গুলের ইশারায় আজাদ করে দিয়েছিলেন। ঘটনা বুঝে থাকলে বলুন, মহানবী (স.)এর জন্মে আবু লাহাব সন্তুষ্ট ছিল না অসন্তুষ্ট? এ পর্যায়ে প্রশ্ন করতে চাই, আবু লাহাবের এই সন্তুষ্টি কি সারাজীবনের জন্য ছিল, নাকি শুধুই ১২ই রবীউল আউয়াল? আবু লাহাব নবীর উপর সন্তুষ্টি সারাজীবনের জন্য দেখিয়েছিল, নাকি শুধুই ১২ই রবীউল আউয়াল একদিন দেখিয়েছিল? তাহলে প্রমাণিত হল, আবু লাহাব শুধু ১২ই রবীউল আউয়াল নবীর জন্মদিনে অত্যন্ত খুশী ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। সুতরাং মনগড়া মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠানে যারা যায় না, এরা যদি ওহাবি হয়, তাহলে তোমরা যারা ১২ মাস নবীর জন্য মুহাব্বত দেখাও না, শুধু ১২ই রবীউল আউয়াল নবীর জন্য মুহাব্বত দেখাও, এটা হলো লাহাবী স্বভাব। মীলাদুন্নবী অনুষ্ঠানে না যাওয়াতে যদি ওহাবী হয়, তাহলে ১২ই রবিউল আউয়ালে নবীর জন্য খুশি দেখাইলে লাহাবী হবে। সারা বছর নবীর প্রতি কোন মুহাব্বত না দেখিয়ে শুধু ১২ই রবিউল আউয়াল নবীর জন্য খুশি দেখালে লাহাবী হবে, লাহাবী হবে, লাহাবী হবে। এবার শুনুন, লাহাব কী? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
تَبَّتْ یَدَاۤ اَبِیْ لَهَبٍ وَّ تَبَّ ؕ﴿۱﴾ مَاۤ اَغْنٰی عَنْهُ مَالُهٗ وَ مَا کَسَبَ ؕ﴿۲﴾ سَیَصْلٰی نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ ۚ﴿ۖ۳﴾ وَّ امْرَاَتُهٗ ؕ حَمَّالَۃَ الْحَطَبِ ۚ﴿۴﴾ فِیْ جِیْدِهَا حَبْلٌ مِّنْ مَّسَدٍ ﴿۵﴾
অনুবাদ- ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুই হস্ত এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোনো কাজে আসেনি। অচিরেই সে দগ্ধ হবে লেলিহান অগ্নিতে। এবং তার স্ত্রীও- যে ইন্ধন বহন করে, তার গলদেশে পাকান রজ্জু।
আবু লাহাবের পরিণতি যে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়া, সেটা সূরায়ে লাহাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্পষ্ট বলে দিয়েছেন। তার অপরাধ ছিল, নবীর জন্মদিনে সে খুশি প্রকাশ করে থাকলেও সারা বছর, সারা জীবন নবীর প্রতি মুহাব্বত দেখায়নি। সারা জীবন আবু লাহাব ছিল নবীর প্রতি বেজার। সুতরাং মনগড়া মীলাদের অনুষ্ঠানে যারা যায় না, তাদেরকে তোমরা যারা ওয়াহাবী বলো, তারা সারা জীবন নবীর জন্মে খুশী। আর তোমরা শুধু আবু লাহাবের মতো ১২ই রবীউল আউয়ালে খুশী। সারা জীবন খুশী থাকলে যদি ওয়াহাবী হতে হয়, তবে শুধু ১২ই রবিউল আউয়াল খুশি দেখালে লাহাবী হবে। এবার বলুন, নবীর জন্মে আপনারা কতদিন খুশি?
আমরা যারা সারা জীবন নবীর জন্মে খুশী, তাতে আমাদেরকে যদি তারা ওয়াহাবী বলে, তাহলে তাদেরকে আমরা বলবো সারা জীবন নবীর জন্মে খুশি না হয়ে শুধু ১২ই রবিউল আউয়াল খুশী হওয়ার করণে তারা হবেন লাহাবী। তার প্রমাণ, তারা সারা বছর নবীর সুন্নাত পালন করেন না, নবীর তরীক্বার ধার ধারেন না, কিন্তু ১২ই রবীউল আউয়াল নবীর জন্ম দিনেই শুধু খুশী দেখান। সুতরাং যারা শুধু ১২ই রবীউল আউয়াল নবীর জন্মে খুশি দেখান, তারা নিঃসন্দেহে, লাহাবী, লাহাবী, লাহাবী। পরকালে আবু লাহাব যাবে যেখানে, তারাও যাবেন সেখানে।
বলছিলাম, দেওবন্দ মাদ্রাসার ঘর নির্মাণে দাগ দেওয়ার জন্য যদি নবী আসতে পারেন, মীলাদ শরীফে আসতে পারবেন না কেন? আমার কথা হল, নবী দেওবন্দেও আসেননি, মীলাদেও আসেন না। আর দুটো কথা বলে আমার কথা শেষ করে দিবো।
প্রথম কথা, হযরত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.)কে যারা হাযির-নাযির বলে, এক মিনিটের জন্য যদি আমি কথাটা মেনে নেই, তাহলে অবস্থা কী দাঁড়ায় শুনুন। হাযির-নাযির অর্থ উপস্থিত তথা বিরাজমান থাকা। বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদের খতীব হচ্ছেন প্রফেসর সালাহ উদ্দীন। তার উদ্দেশ্যে বলতে চাই, তার অন্ধ ভক্ত যারা আছে তাদের উদ্দেশ্যেও বলছি, আপনারা আমার কথা তার কানে পৌঁছে দিন। খতীব সাহেব! আপনি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে হাযির-নাযির বিশ্বাস করেন কি? ইতিপূর্বেকার আপনার বিভিন্ন বক্তব্যে মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, আপনি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে হাযির-নাযির বিশ্বাস করেন। এবার একটা কথা বলুন, আপনি যখন জুমার নামাযের খুতবা দিতে যান, তখন আপনার বিশ্বাসমতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) বায়তুল মুকাররমে উপস্থিত থাকেন।
এবার আপনারা বলুন, নামাযটি পড়ায় কে? সালাহ উদ্দীন নাকি রাসূলুল্লাহ (সা.)? রাসূলকে উপস্থিত রেখেও যে ব্যক্তি নামায পড়াতে যায়, তার মতো জঘন্যতম বেয়াদব আর হতে পরে না। এ রকম জঘন্য বেয়াদবকে আমরা ১৬ কোটি মুসলমানের জাতীয় মসজিদের মিম্বারে দেখতে চাই না।
ভাইয়েরা আমার! মুসলমান হিসেবে আপনাদের জানা থাকার কথা। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) যে রাতে মিরাজে গিয়েছিলেন, বায়তুল মুকাদ্দাসে যখন পৌঁছলেন, তখন আল্লাহ তায়ালা সমস্ত নবী-রাসূলকে একত্রিত করেছিলেন। তখন আল্লাহ তাআলা সমস্ত নবী-রাসূলকে নির্দেশ দিয়েছিলন, দুই রাকাত নামায জামাতের সাথে পড়ার জন্য। সেই পয়গাম্বরী নামাযের জামাতে অনেক ফেরেস্তাও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে নবীদের মধ্য একজন নবীও বাদ ছিলেন না। সেই পয়গাম্বরী নামাযের জামাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত ছিলেন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ এই জামাতে উপস্থিত থাকার কারণে আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)কেও ইমামতি করার অধিকার দেননি, নূহ (আ.)কেও ইমামতি করার অধিকার দেননি, ইবরাহীম (আ.)কেও দেননি, ইসমাইল (আ.)কেও ইমামতি করার অধিকার দেননি, মূসা, ঈসা (আ.)কেও ইমামতি করার অধিকার দেননি। কারণ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) যে জামাতে উপস্থিত থাকেন, সেই জামাতে প্রফেসার সালাহ উদ্দীন কোন ছার, কোন পয়গাম্বরের ইমামতি করার অধিকার থাকে না। এবার বলুন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) যেখানে উপস্থিত, সেখানে সালাহ উদ্দীনের মতো মানুষের ইমামতি করার অধিকার থাকা দূরের কথা, কোন নবী রাসূলেরও ইমামতি করার অধিকার থাকে না। সুতরাং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে হাযির-নাযির জেনেও যে ব্যক্তি ইমামতি করার জন্য মিম্বারে যায়, সে কখনো আশিকে রাসূল হতে পারে না, বরং তার মতো জঘন্যতম বেয়াদব দুনিয়াতে আর হয় না।
দ্বিতীয় কথা- দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসার বাহ্যিক প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত কাসেম নানুতুভী (রাহ.), আর আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)। এটা মুখস্ত কোন কথা নয়, বরং ঐতিহাসিক সত্য। এই জন্য উপমহাদেশের সমস্ত কওমী মাদ্রাসার বাতেনী প্রতিষ্ঠাতা তথা আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা যেহেতু স্বয়ং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.), তাই কওমি মাদ্রাসা সমূহে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)এর আলাদা একটা রুহানী ফয়েজ-বরকত আছে। যেটা আমি আজ আপনাদের চাক্ষুস দেখিয়ে দিতে চাই।
কওমী মাদ্রাসা সমূহে হযরত মুহাম্মাদুর রাসূল্লাহ (সা.)এর এমন কী কী রুহানী ফয়েজ-বরকত আছে, যেগুলো অন্য মাদ্রাসায় নাই? তাহলে শুনুন- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রবিত্র কুরআনের এক আয়াতে ইরশাদ করেন-
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَۃٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَۃٌ لِّیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ
এই আয়াতের মর্ম হলো, মুসলমানদের মধ্য থেকে এমন কিছু লোক বের হয়ে যাও ইসলামী শিক্ষা-দিক্ষা হাসিল করার জন্য। মুফাসসিরীন কেরাম লেখেন, আল্লাহ যদি ‘লিইয়াতাকাফাহু’ না বলে ‘লিয়াতাআল্লামূ’ বলতেন, তাহলে আয়াতের মর্ম হতো শুধু ইসলামী শিক্ষা হাসিলের জন্য বের হয়ে যাও। আল্লাহ এটা বলতে চাননি। শিক্ষার সাথে দিক্ষা লাগবে বুঝাবার জন্য লিয়াতাআল্লামূ না বলে লিয়াতাফাক্কাহু বলেছেন। সুতরাং মাদ্রাসা শিক্ষার বৈশিষ্ট্য হলো, ইলমের সাথে সাথে আমল।
এবার বলুন! শিক্ষার সাথে সাথে আমল অন্য মাদ্রাসায় বেশি পাওয়া যায়, না কওমি মাদ্রাসায় বেশি পাওয়া যায়? এবার বলুন, এটা কিসের বরকতে সম্ভব হয়েছে? কওমী মাদ্রাসার আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছিলেন, তাঁর বরকতেরই ফল এটি। এই লিয়াতাফাক্কাহু শব্দের তাফসীরে মুফাক্কিহীনে কিরাম আরো লিখেছেন, কুরআন-হাদীস নিজের মতো করে শিখতে চাইলে নির্ভেজাল মুসলমান হতে পারবে না। কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা ও মর্ম নিতে হবে নবীর সুন্নাত এবং সাহাবায়ে কিরামের জীবনাচার থেকে। আর তখনই ভুল ব্যাখ্যার অবকাশ থাকবে না এবং তাতে নির্ভেজাল মুসলমান হওয়া যাবে। এই রূপরেখাতে যারা নিজেদের জীবন গড়ে নিতে পারবেন, তাদেরকেই বলা হবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত।
পৃথিবীর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে কাসসাফ। এই তাফসীরের রচয়িতার নাম জারুল্লাহ জামাখশারী। সারা পৃথিবীর সমস্ত আলেমগণ তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকেন এবং আল্লামা উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু সুন্নাতে রাসূল এবং জামাতে সাহাবাকে সত্যের মাপকাঠি রূপে গ্রহণ না করার কারণে পৃথিবীর বিখ্যাত মুফাসসীরে কুরআন হওয়া সত্ত্বেও তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি।
সুতরাং কুরআনের ইলম শুধু শিখলে হবে না, হাদীস মতে আমল করলেই শুধু হবে না, সুন্নাতে রাসূল এবং জামাতে সাহাবাকে সত্যের মাপকাঠিও মানতে হবে। এটাই কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার আদর্শ। এই আদর্শ অন্য মাদ্রাসা থেকে কওমী মাদ্রাসায় বেশি পাওয়া যায়। এটা হযরত মুহাম্মাদু রাসূলুল্লাহ (সা.)এর কওমি মাদ্রাসার আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার বরকত।
আল্লাহ তাআলা ইরশা করেন- وَلِیُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْۤا اِلَیْهِمْ لَعَلَّهُمْ یَحْذَرُوْنَ
অর্থাৎ- “এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে; যাতে তার সতর্ক হয়”।
মাদ্রাসা শিক্ষিতদের কর্মজীবনের দায়িত্ব ডাক্তার হওয়া নয়, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া হওয়া নয়, বৈজ্ঞানিক হওয়া নয়। মাদ্রাসা শিক্ষিতদের কর্মজীবনের দায়িত্ব জাতিকে পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ প্রদর্শনকারী একদল নায়েবে নবী তথা ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া তৈরি করা। মাদ্রাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য সবচেয়ে বেশি কওমী মাদ্রাসার দ্বারাই অর্জিত হয়। হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) কওমি মাদ্রাসার আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার বরকতের ফল এটা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলমানকে বিষয়টা যথাযথভাবে অনুধাবন করার তাওফীক দান করুন। আমীন॥