খতম তারাবীহ এর হাদিয়া, হাফেজ সাহেবদের জানা জরুরী

বর্তমান বিশ্বে দ্বীনি ইলমের অন্যতম কেন্দ্র হলো দারুল উলূম দেওবন্দ। এ প্রসঙ্গে দারুল উলূম দেওবন্দের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত বিষয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয় দারুল উলূম দেওবন্দ থেকেই। পুস্তিকাটি দারুল উলূম দেওবন্দের ওয়েব সাইটে পাওয়া যায়। নাম : معاوضہ علی التراویح کی شرعی حیثیت (শরীয়তের দৃষ্টিতে তারাবীর বিনিময়)। দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম হযরত মাওলানা মুফতী আবুল কাসেম নোমানী দা. বা. এর নির্দেশনায় ১৪৩৪ হিজরীতে বিস্তারিত এ ফত্ওয়া প্রকাশিত হয়। ভূমিকায় পুস্তিকাটি রচনার প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে বলা হয়েছে :

তারাবীর বিনিময় প্রসঙ্গে সময়ে সময়ে বিভিন্ন প্রশ্ন দারুল ইফতায় আসতে থাকে। বিশেষ করে রমযানে মানুষ এ বিষয়ে বেশি প্রশ্ন করে থাকে। বিগত দিনে কোনো কোনো এলাকা থেকে এ সংবাদ এসেছে যে, দারুল উলূম দেওবন্দের ফত্ওয়া বিভাগ এ মাসআলায় পূর্বমত থেকে ফিরে এসেছে। এমনকি অন্ধ্র প্রদেশের নিজামাবাদ শহর থেকে একটি প্রশ্ন আসে, যার সঙ্গে একটি লিফলেটও ছিল। লিফলেটে মারাত্মক প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দের মুফতীয়ানে কেরাম, এমনকি আকাবির উস্তাদগণের নামে এ ভ্রান্ত কথা প্রচার করা হয়েছে যে, তাঁরা সকলে একমত হয়ে তারাবীর বিনিময়কে জায়েয ফত্ওয়া দিয়েছেন।…

অপর এক লিফলেটে হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. এর দিকে সম্বন্ধ করে তারাবীর বিনিময় জায়েয হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে মুফতী সাহেবের দীর্ঘ একটি লেখার অসম্পূর্ণ উদ্ধৃতি পেশ করে ভুল ফলাফল বের করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে।……-মুআওয়াযা আলাততারাবীহ, ভূমিকা : ৩

এ প্রেক্ষাপট সামনে রেখেই মানুষের ভুল ধারণা দূর করার লক্ষ্যে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে কেন্দ্রীয় ফত্ওয়া প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তো মূল ফতওয়ার উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠকের সামনে তুলে ধরছি :

* معاوضہ علی التراویح তথা তারাবীর বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয নয়।

* তারাবীর বিনিময় গ্রহণ করা নিঃশর্তভাবে নাজায়েয। চাই তাকে কোরআন শরীফ খতমের বিনিময় ধরা হোক বা তারাবীর ইমামতির বিনিময়।

* বহু আকাবির মুফতীয়ানে কেরামের ফত্ওয়ায় তারাবীর ইমামতির বিনিময়কে সুস্পষ্টভাবে নাজায়েয সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন ই’লাউস সুনান-এর লেখক মাওলানা যফর আহমদ উসমানী এক প্রশ্নের জবাবে লেখেন :

والأصل فيه ما حققه ابن عابدين في رسالته شفاء العليل وبل الغليل من حرمة الإجارة …

এ দীর্ঘ বক্তব্যের সারকথা হলো, শুধু তারাবীর ইমামতির বিনিময় নেওয়া জায়েয নয়। কারণ, যে জরুরত বিবেচনা করে কোরআন শরীফের তা’লীম, ফরয নামাযের ইমামতি, আযান ইত্যাদির বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয বলা হয়েছে, সে জরুরত তারাবীতে সাব্যস্তই হয় না। কেননা, উল্লিখিত বিষয়গুলো হয় ফরযের অন্তর্ভুক্ত, না হয় সুন্নতে মুআক্কাদার অন্তর্ভুক্ত। আর তারাবীর ইমামতি সুন্নতে কেফায়াহ। এরপর তারাবীর ইমামতি সুন্নতে কেফায়া হওয়ার পক্ষে কিছু ইবারত দ্বারা দলীল পেশ করার পর হযরত মাওলানা যফর আহমদ উসমানী রহ. বলেন, উল্লিখিত ইবারত থেকে বোঝা গেল, তারাবীর বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয নয়, কেবল ইমামতির বিনিময়েও নয়, কেবল খতমের বিনিময়েও নয়।

অতএব তারাবীর বিনিময়কে যদি কোরআন শরীফের খতমের বিনিময় ধরা হয় তাহলে তো তা নাজায়েযের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। যদি তারাবীর ইমামতির বিনিময় ধরা হয় তাহলে এ সন্দেহ হতে পারে যে, পরবর্তী যুগের হানাফী ফক্বীহগণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ইমামতির বিনিময় গ্রহণ করাকে জায়েয বলেছেন অতএব এর ওপর কিয়াস করে তারাবীর ইমামতির বিনিময়ও জায়েয হবে। কিন্তু আকাবির উলামায়ে কেরাম এতদুভয়ের মাঝে পার্থক্য সুস্পষ্ট করে এ সন্দেহ দূর করে দিয়েছেন। সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, এ নামেও (তারাবীর ইমামতি) বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয নয়।

অবশ্য আকাবিরের কারও কারও ফত্ওয়ায় অনুগামী (تبعا) হিসাবে তারাবীর বিনিময় গ্রহণের কথা পাওয়া যায়। কিন্তু বুঝতে হবে, যারা অনুগামী (تبعا) হিসাবে তারাবীর বিনিময় গ্রহণের সুযোগের কথা বলেছেন তারাও নিঃশর্তভাবে বলেননি। যেমন হযরত ফক্বীহুল উম্মত রহ. বলেন, ‘মূল মাযহাব তো নাজায়েযই। তবে উল্লিখিত সুরতে উল্লিখিত কৌশল অবলম্বনের সুযোগ (گنجایش) আছে।’ এখানে হযরত উল্লিখিত সুরত ও উল্লিখিত কৌশলের সঙ্গে ‘সুযোগ’ (گنجایش) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আর হযরত মাওলানা আব্দুর রহীম লাজপুরী রহ. বলেন : ‘অনন্যোপায় (مجبورا) হলে এ সুরত অবলম্বন করতে পারে যে, হাফেয সাহেবকে রমযানের জন্য সহকারী ইমাম নিযুক্ত করবে। এশা ও অন্য এক-দুই ওয়াক্ত নামায তার জিম্মায় থাকবে। পাশাপাশি তারাবীহও পড়াবে। তো এ কৌশল অবলম্বন করলে মসজিদের ফান্ড থেকে সহকারী ইমাম হিসাবে বিনিময়ের লেনদেন জায়েয হবে।’

এখানে হযরত অনন্যোপায় (مجبورا) শব্দ উল্লেখ করেছেন। বোঝা গেল আকাবিরের কেউ কেউ যে অনুগামী (تبعا) হিসাবে বিনিময় গ্রহণের সুযোগের কথা বলেছেন, তাও মজবুরির সুরতে। অন্যথায় তাও নিঃশর্তভাবে সতর্কতার পরিপন্থী।

টীকা : বরং হযরত থানভী রহ. শেষে এ সুরতকেও নাজায়েয বলেছিলেন। হযরত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ জায়েয হওয়ার ফত্ওয়া ওই সুরতে যখন কেবল ইমামতিই উদ্দেশ্য হবে। অথচ এখানে মূল উদ্দেশ্য কোরআনের খতম। এটা (দু-এক ওয়াক্তের ইমামতি) একটি হীলা বা কৌশলমাত্র। যেহেতু দিয়ানাতের ক্ষেত্রে মুআমালা হয় বান্দা ও আল্লাহর মাঝে তাই হীলা-কৌশল কোনো কিছুকে জায়েয করতে পারে না। অতএব তা নাজায়েযই হবে। (ইমদাদুল ফাতাওয়া : ১/৪৮৫, তারাবীহ পরিচ্ছেদ, প্রশ্ন : ৪১০, ইদারায়ে তালীফাতে আওলিয়া, দেওবন্দ)

হযরতের এ জবাবের ওপর টীকা লিখতে গিয়ে মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ. বলেন, একটি মূলনীতি হলো, الأمور بمقاصدها (অর্থাৎ সকল বিষয় তার উদ্দেশ্যের দিক থেকেই বিবেচ্য হয়ে থাকে)। অতএব কোনো হাফেয সাহেবকে যখন কোরআন শরীফ খতমের জন্য তারাবীর ইমাম বানানো হয় তখন তো এটা সুস্পষ্টই যে তার দ্বারা উদ্দেশ্য ইমামতি নয়, কোরআনের খতম। (ফাতাওয়া দারুল উলূম জাদীদ : ৪/২৭৩) কিন্তু হযরত মুফতী কিফায়াতুল্লাহ রহ. এ হীলা-কৌশলকে জায়েয ফত্ওয়া দিয়েছেন। তিনি বলেন, যদি রমযান মাসের জন্য হাফেয সাহেবকে বেতনভুক্ত করে নিযুক্ত করা হয় এবং এক-দুই ওয়াক্ত নামাযে তাকে সহকারী ইমামতির জিম্মা দেওয়া হয় তাহলে এ সুরত জায়েয। কারণ, ইমামতির বিনিময়কে (বেতন) ফুকাহায়ে কেরাম জায়েয বলেছেন। (টীকা, ফাতাওয়া রহীমিয়া : ২/৫)

কিন্তু এটা তো স্পষ্টই যে, এটা কেবলই একটি হীলা বা কৌশল। এখানে উদ্দেশ্য কোরআনের খতমই। ইমামতি কখনোই উদ্দেশ্য নয়। আর দিয়ানতের ক্ষেত্রে হীলা-কৌশল জায়েযের ফায়দা দেয় না। فالحق ما أفتى به المجبيب قدس سره العزيز -সাঈদ আহমদ (টীকা, ইমদাদুল ফাতাওয়া : ১/৪৮৫, তারাবীহ পরিচ্ছেদ, প্রশ্ন : ৪১০, ইদারায়ে তালীফাতে আওলিয়া, দেওবন্দ)

* তারাবীর ইমাম ও মসজিদ কর্তৃপক্ষের মাঝে বিনিময়ের ব্যাপারে কোনো কথাবার্তা হয়নি। তবে ওই এলাকায় কোরআন খতমের বিনিময় লেনদেনের রেওয়াজ আছে। এ পরিস্থিতিতে ফিকহের প্রসিদ্ধ মূলনীতি المعروف كالمشروط (অর্থাৎ প্রচলিত বিষয় শর্ত করার মতোই হয়ে থাকে।) এর ভিত্তিতে তারাবীর বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয হবে না।…

* حبس وقت এর দোহাই দিয়ে তারাবীর বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয হবে না। কারণ, যে সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কেরাম বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয বলেছেন তার মূল কারণ হলো ضياع دين তথা দ্বীন বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। (এটাকেই জরুরত শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।) حبس وقت জায়েযের মূল কারণ নয়। না হয় حبس وقت কে যদি জায়েযের কারণ সাব্যস্ত করা হয় তাহলে তো সব ইবাদতেই বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয হবে। কারণ সকল ইবাদতের মধ্যেই حبس وقت পাওয়া যাবে। আর এটা তো স্পষ্টই যে উল্লিখিত জরুরত তারাবীতে সাব্যস্ত হয় না। অতএব তারাবীর বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয হবে না।-মুআওয়াযা আলাততারাবীহ : ১২-২৬

এ পুস্তিকার শুরুতে মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ. এর সত্যায়ন-বক্তব্য যুক্ত রয়েছে। হযরতের বক্তব্যের একটি অংশ হলো : معاوضہ علی التراویح প্রসঙ্গে বিস্তারিত ও দলীলভিত্তিক এ ফত্ওয়ার প্রতিটি শব্দ সঠিক। আল্লাহ তাআলা সংকলককে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমার একটি বক্তব্য, যা এ মাসআলার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়; বরং আনন্দ-উৎসবের মুহূর্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাকে কিছু লোক জোর করে তারাবীর বিনিময় জায়েয হওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে, যা সুস্পষ্ট প্রতারণা। আমার বক্তব্য ছিল : ‘আনন্দ-উৎসব উপলক্ষ্যে মসজিদ কমিটি ও মুসল্লীদের উচিত ইমাম সাহেবদের বাড়তি খেদমত করা। উম্মতের মাঝে এরও প্রচলন আছে। যদিও তা অনুগামী (ضمنا و تبعا) হিসাবে সাব্যস্ত হবে। এটাকে স্বতন্ত্রভাবে বাড়তি বিনিময় তো বলা যায় না। তবে এটা একধরনের পুরস্কার।’

এ বক্তব্য আনন্দ-উৎসবের সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারাবীর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ঈদুল ফিতরের সঙ্গে সম্পর্ক হতে পারে। আর অনুগামিতার (ضمنا و تبعا) অর্থ হলো এটা বেতনের অংশ নয় যে ইমাম সাহেবগণ তার দাবি করতে পারেন। এটা কেবলই পুরস্কার। যা দাতাগণের মর্জির ওপর নির্ভরশীল।-মুআওয়াযা আলাততারাবীহ : ০৭

আশা করি এ বিষয়টি সকলেই লক্ষ রাখব।

Loading