হাদিসের বিশুদ্ধতম গ্রন্থ বুখারি শরিফে একটি পূর্ণ অধ্যায়ের নামকরণ করা হয়েছে – পানি পান করানোর ফজিলত শিরোনামে।
কাউকে পানি পান করানোর বিষয়টি আজ আমাদের কাছে হয়তো আহামরি কোনো দান কিংবা বিষয় নয়, অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এ সামান্য কাজটিও অভাবনীয় পূণ্যের কাজ।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,” সবচেয়ে উত্তম সদকা হলো মানুষকে পানি পান করানো।”
(আহমদ, আবু দাউদ)
“পানি পান করানোর চাইতে বেশি নেকি আর কোনো সদকাতে নেই।”
(বায়হাকী শু’আবুল ঈমান ৩১০৫)
হজরত সাদ বিন উবাদা (রা.) এসে নবীজিকে (সা:) বললেন, হে আল্লাহর নবী (সা:)! আমার মা মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি তার জন্য কোনো কিছুর ওসিয়ত করে যাননি। আমি যদি তার পক্ষ হয়ে কিছু সদকা করি, তবে কি তা আমার মায়ের কোনো উপকারে আসবে?
নবীজি বললেন, হ্যা, হবে।
তুমি মানুষকে পানি পান করাও।
ইমাম কুরতুবি একটি আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে বলেছেন, যার গুনাহ বেশি হয়ে গেছে, সে যেন মানুষকে পানি পান করায়।
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, একদা জনৈক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল ।
এমন সময় তার খুব পিপাসা লাগলে সে এক কূপে নেমে পানি পান করল ।
সে কূপ থেকে উঠে দেখতে পেল, একটা কুকুর হাপাঁচ্ছে এবং পানির পিপাসায় কাতর হয়ে মাটি চাটছে ।
সে ভাবল বোধহয় কুকুরটারও আমার মত পিপাসা লেগেছে ।
তার পর সে কূপে নেমে নিজের মোজা ভরে পানি নিয়ে মুখ দিয়ে কামড়ে ধরে উপরে উঠে এবং কুকুরটিকে পান করায় ।
মহান আল্লাহ তার এ কাজ কবুল করেন এবং তার গুনাহ মাফ করে দেন ।
সাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) চতুস্পদ জন্তুর উপকার করলে তাতেও কি আমাদের সওয়াব হবে?
উত্তরে হুযুর (সাঃ) বলেন, প্রত্যেক সজীব বস্তু ও প্রাণীর উপকার করাতেই সওয়াব রয়েছে ।
(বুখারীঃ১০৫৫)
সামান্য কুকুরের তৃষ্ণা মেটানোয় যদি এতো বড়ো পুরস্কার হয়, তবে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে পানি পান করানোর বিনিময় আরও কতো মহান হতে পারে- তা কি কখনো ভেবে দেখেছি!
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোথাও একটি কূপ খনন করে দেয় এবং তারপর সেখান থেকে কোনো মানুষ, পশু-পাখি অথবা কোনো প্রাণীও যদি পানি পান করে, তবে প্রত্যেকটির বিনিময়ে আল্লাহ পাক তাকে কিয়ামতের দিন নেকি দান করবেন। এখানে শুধু কূপ নয়, বরং শহর ও অঞ্চল ভেদে যে কোনোভাবে পানি পান করার ব্যবস্থা করে দেওয়ার ফজিলত বোঝানো উদ্দেশ্য।
আততারগিব ওয়াততারহিব গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, হাদীস শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম হাকেম একবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার চেহারায় ফোড়া দেখা দিল এবং আকৃতি যেন বদলে গেল। তখন তিনি তার বাড়ির দরজায় সাধারণ পথচারীদের জন্য পানি পানের ব্যবস্থা করে দিলেন। লোকেরা চলতিপথে পিপাসার্ত হলে সেখান থেকে পানি পান করে নিত। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন। তার চেহারায় আগের চেয়েও সৌন্দর্য বেড়ে গেল। ইমাম হাকেম মূলত ওই হাদীসের ওপর আমল করেছিলেন, যেখানে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা তোমাদের অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য সদকা করো, এতে তাদের সুস্থতা নিহিত।
প্রসিদ্ধ ইমাম ও বুজুর্গ হজরত আব্দুল্লাহ বিন মুবারকের কাছে এক লোক এসে তার হাঁটুতে ক্ষত সম্পর্কে জানালো। লোকটি বললো, আমি অনেক ধরনের চিকিৎসা করিয়েও কোনো সুফল পাচ্ছি না। আব্দুল্লাহ বিন মুবারক তখন তাকে বললেন, যাও, অমুক জায়গায় গিয়ে সেখানে একটি কূপ খনন করে দাও। ওখানকার মানুষ পানির জন্য কষ্ট পায়। আমি আশা করি, এতে তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। লোকটি তার কথা মতো সেখানে একটি কূপ খনন করে দিল ও সত্যিই কয়েকদিন পর সে সুস্থ হয়ে উঠলো।
আজকের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের পরকালীন আমলনামাকে সমৃদ্ধ করতে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ আমাদের সবার হয়ে ওঠে না। অর্থ ও সাধ্যের অভাবে বড় অঙ্কের দান করাও আমাদের সবার জন্য সম্ভব নয়। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা যদি স্ব স্ব অবস্থানে থেকে পিপাসার্ত মানুষের পিপাসা মেটাতে কিছু করার উদ্যোগ নিই, তবে কাল কিয়ামতের মাঠে এটুকুই হয়তো আমাদের জন্য অনেক বড় সঞ্চয় হয়ে থাকবে।
সামান্য এক গ্লাস পানির বিনিময়ে যদি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাক আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান, তবে এমন সৌভাগ্যবান আর কে আছে!
মধ্যপ্রাচ্যে গ্রীষ্মের সময় বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে কিংবা পথচারী অথবা উন্মুক্ত স্থানে কর্মরত শ্রমিকদের মাঝে প্রচুর পরিমাণে শীতল পানি বণ্টনের অনুপম দৃষ্টান্ত দেখা যায়।
অনেকে সওয়াবের আশায় পথ কিংবা মসজিদের ধারে ট্যাঙ্ক স্থাপন করে শীতল সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেন।
এমনকি আমার মা কেও দেখেছি বাসার উঠানে বড় বাটিতে পানি রাখতে, আর তা দিয়ে পাখি, বিড়াল আর কুকুর পানি খেয়ে যেতে আলহামদুলিল্লাহ!
এটা আমরা বাসার ছাদেও রাখতে পারি!
কোনো সুযোগ মিস করা যাবে না ইনশাআল্লাহ!
” যদি কোনো মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে পিপাসার্ত অবস্থায় পানি পান করায় তাহলে আল্লাহ তাকে রাহিকুল মাখতুম (জান্নাতের বিশেষ পানীয়) থেকে পান করাবেন।”
(আহমদ, আবু দাউদ)