আশূরা শব্দটি এসেছে আরবী ভাষার আশারাতুন শব্দ থেকে। যার অর্থ হচ্ছে দশ। এই দিনটি মুহাররম মাসের ১০ তারিখ হওয়ায় এর নাম দেওয়া হয়েছে আশূরা। ঐতিহাসিক এই দিনটি ধর্মীয়ভাবে বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
তবে এ সম্পর্কে আমাদের মাঝে কিছু বিভ্রান্তিও রয়েছে। মনে রাখতে হবে সবকিছুর মূল্যায়ন ঠিক সেভাবেই করতে হবে যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম করেছেন। মনগড়া আমলে বিন্দুমাত্র কোনো ফায়দা তো হবেই না বরং মারাত্মক গুনাহ হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
من احدث في امرنا هذا ما ليس منه فهو رد
যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে এমন কিছু ঢুকালো যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত। সহিহ বুখারী, হাদিস নম্বর: ২৬১৯
এখন আসুন! আমরা লক্ষ্য করি কুরআন-সুন্নাহ্ তে মুহাররম ও আশূরা সম্পর্কে কী রয়েছে:
কুরআন মজীদে ও হাদীস শরীফে এ মাস সম্পর্কে যা এসেছে তা হলো, এটা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণমাস। কুরআনের ভাষায় এটি ‘আরবাআতুন হুরুম’-অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম।
এ মাসে রোযা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ।’
أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم
-সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিযী ১/১৫৭
এর মধ্যে আশুরার রোযার ফযীলত আরও বেশি।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’
ما رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يتحرى صيام يوم فضله على غيره إلا هذا اليوم يوم عاشوراء وهذا الشهر يعني رمضان
-সহীহ বুখারী ১/২১৮
হযরত আলী রা.কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপসি’ত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’-জামে তিরমিযী ১/১৫৭
অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’
صيام يوم عاشوراء أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله
-সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিযী ১/১৫৮
আশুরার রোযা সম্পর্কে এক হাদীসে আছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ।’
صوموا عاشوراء وخالفوا فيه اليهود، صوموا قبله يوما أو بعده يوما
-মুসনাদে আহমদ ১/২৪১
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোযা রাখব।’-সহীহ মুসলিম ১/৩৫৯
মুহাররম ও আশুরাকেন্দ্রিক নানা কুসংস্কার:
এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।-সহীহ বুখারী ১/৪৮১
তবে এ দিনের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকেন। যেমন, এদিন হযরত ইউসুফ আ. জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইয়াকুব আ. চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। হযরত ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইদরীস আ.কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। অনেকে বলে, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই।-আল আসারুল মারফূআ, আবদুল হাই লাখনেবী ৬৪-১০০; মা ছাবাহা বিসসুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ ২৫৩-২৫৭
এ মাসের একটি ঘটনা শাহাদাতে হুসাইন রা.। বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা-‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয়ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।’
অন্য হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।’
অতএব শাহাদাতে হুসাইন রা.কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য।
এ মাসে যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় তার মধ্যে তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ করা যায়।
এজন্য অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকে। বলাবাহুল্য এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার।
মোটকথা, এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো যখা, তওবা- ইস্তেগফার, নফল রোযা এবং অন্যান্য নেক আমল। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কুরআন্তসুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
আমাদের মাঝে এসব বিদআতের মারাত্মক অংশ এসেছে অন্যতম বাতিল ফিরকাহ্, শিয়া সম্প্রদায় হতে । আর শিয়াদের মধ্যে বিভিন্ন দল উপদল রয়েছে তবে তাদের অধিকাংশই কাফের। শিয়ারা কেন কাফের, সে সম্পর্কে বিস্তারিত এখানে আলোচনা করবো না। তবে তাদের দু-একটি আকীদা উল্লেখ করছি; যা থেকে স্পষ্টই বোঝা যাবে, তারা কেন কাফের?
এক. শিয়াদের একটি মৌলিক আকীদা হলো: আল্লাহ রব্বুল আলামীন জিব্রাইল আলাইহিস সালাম কে ওহী নিয়ে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর কাছে প্রেরণ করেছিলেন কিন্তু জিব্রাইল ভুল করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট অবতীর্ণ করেন। (আল মুনিয়াহ ওয়াল আমাল ফী শরহিল মিলালি ওয়ান নিহাল, পৃ: ৩০)
দুই. তারা বিশ্বাস করে, কোরআনে অনেক ভুলত্রুটি রয়েছে। সঠিক কুরআন তাদের ধারণা মোতাবেক সাহাবায়ে কেরামের মাঝে ইরতিদাদ দেখা দেওয়ার পর আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। (আত তানবীহ্ ওয়ার রদ, পৃ:২৫)
তিন. তাদের কালেমায় ভিন্নতা রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ এর সাথে বলতে হবে যে ওয়া আলিইউন ওয়ালীউল্লাহ অর্থাৎ আলী আল্লাহ তা’আলার ওয়ালি। আজানে তারা এই বাক্যটি ব্যবহার করে। এমনকি মৃত ব্যক্তিকেও এই কালেমা বলে তালকিন করে। (ফুরুউল কাফী, খ: ৩ পৃ: ৮২)
চার. তাদের বিশ্বাস, আল্লাহ তা’আলা এবং তাদের ইমামদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। (মাসাবিহুল আনওয়ার ফী হাল্লি মুশকিলাতিল আখবার, খন্ড:২ পৃষ্ঠা ৩৯৭)
পাঁচ. শিয়াদের একটি উপদল ইমামিয়্যাহ্। তারা তাদের ইমামদেরকে আল্লাহ তা’আলার গুণে গুণান্বিত বলে বিশ্বাস করে। এমনকি তারা তাদেরকে আল্লাহর নামে ডেকে থাকে। (উসূলুল কাফী, খ:১ পৃষ্ঠা: ৩১০)
ছয়. শিয়াদের ধারণা তাদের ইমামরা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে অহী ব্যতীত কথা বলেন না; এ ব্যাপারে সকলকে ঈমান আনতে হবে। (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড: ১৭ পৃষ্ঠা: ১৫৫)
সাত. শিয়াদের আরেকটি আক্বীদা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিকে সর্বপ্রথম আহলে বাইতের ভালোবাসা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড: ২৭, পৃষ্ঠা: ৭৯)
আট: শিয়াদের অন্যতম প্রধান আক্বীদা হচ্ছে, তাকিয়া অর্থাৎ সত্যগোপন করা এবং নিজের অন্তরের বিশ্বাসটিকে প্রকাশ না করা। অন্যভাবে বলা যায়, তাকিয়া অর্থ হলো, ধোঁকাবাজি ও মোনাফেকির একটি সমন্বিত পদ্ধতি। এই তাকিয়া যে বিশ্বাস করবেনা তার ঈমান থাকবে না বলে তারা মনে করে। (উসূলুল কাফী, খন্ড ২, পৃষ্ঠা: ৫৭৩) এই তাকিয়া বর্জন করা তাদের নিকট নামাজ বর্জন মতো অপরাধ।
নয়. শিয়াদের একটি বিশ্বাস হলো, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলার নিকট নয় বরং তাদের ইমামদের নিকট হিসাব দিতে হবে। (উসূলুল আইম্মাহ্, খ:১ পৃষ্ঠা: ৪৪৬)
দশ. শিয়াদের শায়েখদের অভিমত হচ্ছে, ইমামদের কবরের দিকে হজ করা কাবার দিকে হজ করার থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সওয়াবের কাজ। (ছাওয়াবুল আমাল ওয়া ইকাবুল আমাল, পৃষ্ঠা: ১২১-১২২)
এগারো: শিয়ারা হযরত আবু বকর, হযরত উমার, হযরত উসমান, হযরত আয়েশা, হযরত হাফসা, রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুম আজমাইনকে কাফের মনে করে। এ বিষয়ে তাদের বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ রয়েছে এবং তাদের এ ধরনের আকীদা বিশ্বাস অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।
এরকম অসংখ্যা বাতিল আক্বিদায় পূর্ণ শিয়া গোষ্ঠিটি। এ কারণেই বর্তমান রাফেজী শিয়াদের উলামায়ে কেরাম কাফের বলে ফাতওয়া দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের এ বাতিল আক্বিদাপন্থীদের থেকে সকলের ঈমান আমলকে হিফাযত করুন। আমীন।