আরবী তারিখঃ এখন ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি মুতাবিক, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রোজ বুধবার, সময় রাত ৮:৪৬ মিনিট

আমি উলামায়ে কিরামের বিরোধী নই, কিন্ত সনদের সরকারী স্বীকৃতি বিরোধী!

نحمده و نصلي علي رسوله الكريم اما بعد

ভাই ভুল বোঝাবুঝির কিছু নেই, আমি সর্বোচ্চ ওলামায়ে কেরামের বিরোধী নই এবং এটি একটি কঠিন অপআদর্শকে গ্রহণ করার নাম সনদের স্বীকৃতি৷ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ওলামায়ে কেরাম সনদের স্বীকৃতি নেয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন৷ কাউকে সমর্থন করা এবং মানা এক জিনিস নয়৷ হকপন্থি ওলামায়ে কেরাম সবাইকেই সমর্থন করি, কিন্তু মানি একজনকে৷ কেননা সবাইকে একসাথে মানা যায় না৷ এজন্য যে, একাধিক ওলামায়ে কেরামের একটি বিষয়ের উপর একাধিক পরামর্শ বা মন্তব্য থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ যেদিন থেকে বুঝে এসেছে শুধুমাত্র জেনে লাভ নেই কাউকে না কাউকে মানতে হবে, সেদিন থেকে আমার শাইখ ফকিহুল মিল্লাত রহঃ কে মানার চেষ্টা করে এসেছি৷ হযরত রহঃ এর ইন্তেকালের পরে তারই আদর্শিত রাহবারে তরিকত শাহ মুফতি সুহাইল দাঃ বাঃ কে মানার চেষ্টা করছি৷ আমার জানামতে উভয় মুরুব্বির আদর্শ ও চেতনা এক ও অভিন্ন৷ আমরা তখন মিশকাত শরীফ পড়ি, হযরত ফকিহুল মিল্লাত রহঃ সনদের সরকারি স্বীকৃতি উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিলেন৷ হযরতের ভাষণটি রেকর্ড করা হলো৷ বললেন সনদের স্বীকৃতির কি কি হয়েছিল৷

হযরত রহঃ বলেন : “সনদের স্বীকৃতির জন্য পাগল হয়ে গেছি আমরা, সনদের স্বীকৃতির পক্ষের ছাত্ররাতো আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো, কারণ সনদের স্বীকৃতি এত ব্যাপক হয়ে গেছিল যে, খোদ আমরা কওমি মাদ্রাসার মুরুব্বীরা, অনশন করল, ধর্মঘট করল, সনদ দিতে হবে আমাদেরকে, স্বীকৃতি দিতে হবে, তখন আমি হযরত মাওলানা সায়্যিদ আসয়াদ মাদানি রহঃঃ এর কাছে গেলাম এবং বললাম হুজুর, আমাদের দেশে তো এই অবস্থায় কি করা যায়? তো হযরতে বললেন “اس کا مطلب یہ ہے کہ تمہارے یہاں دینی مدارس دار العوم دیوبند کے اصول پر رہیںگا نہیں” এরপর গেলাম হারদুঈ, হারদুই যাইয়া বললাম হরদুঈ হযরতকে আমাদের দেশে এই অবস্থা, তো হরদুঈ হযরত বললেন যে, “کون کر رہا” সনদের স্বীকৃতি নেয়ার জন্য আন্দোলন “کون کر رہا؟” তো মাই নে কাহা, “بنگلہ دیش کے بڑے بڑے علمائے کرام جس میں حضرت کے مریدین بھی ہیں” হযরত বললেন “تو اب اس کا مطلب یہ ہے کہ دینی مدارس رہیگا نہیں بنگلہ دیش میں” তো আমি বললাম হযরত এখন করনীয় কি? চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কোন কিছু করার নেই, তো হযরত বললেন “حق بات سے چپ رہ نہیں سکتے. حق بات کہتے رہو ادب کے ساتھ نرمی کے ساتھ” তো আমি যতটুকু পেরেছি করেছি, সনদের স্বীকৃতি আমাদের মুরুব্বী দের ইতিহাসে নাই, হ্যা হযরত আসয়াদ মাদানী রহঃ আমাকে বলেছিল, “تم سند کی منظوری لینے کیلئے تحریک کر رہے ہو؟” তোমরা সনদের স্বীকৃতি নেওয়ার জন্য আন্দোলন করতেছো, “اور ہماری حکومت سند کی منظوری دینے کیلئے بلا رہیں ہیں” ভারত সরকারে ডাকতেছে, আমরা সনদের স্বীকৃতি দিতে চাই, তুমি আসো, তো আমি বলছি “تم اپنی راہ چلو ہم اپنی راہ چلتے ہیں” হুকুমত কে বলছি তোমরা তোমাদের চলো, আমরা আমাদের চলি, তোমার সনদের মনযুরী নিবো না, উনি যখন মারা গেলেন, তখন ভারত সরকার মনে করেছিল যে, এইবার সনদ স্বীকৃতি দিতে পারবে, কিন্তু পারে নাই, সঙ্গে সঙ্গে দারুল উলুম দেওবন্দ, সায়্যিদ আরশাদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুম পুরা হিন্দুস্থানের কওমি মাদ্রাসার সকল ওলামায়ে কেরামকে একত্র করে একসঙ্গে আওয়াজ ওঠালেন, “আমরা তোমার কোন সনদের স্বীকৃতি চাই না” তেমনি ভাবে আমি পাকিস্তানের মুফতি তকী উসমানী দাঃ বাঃ এর সাথে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করি, তিনি আমাকে সনদের সরকারি স্বীকৃতির ক্ষতি সম্বন্ধে পূর্ণ অবগত করেন এবং এটা নেয়া থেকে বিরত থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন৷ আমি এজন্য বলছিলাম আমাদের সনদের স্বীকৃতি হবে দারুল উলুম দেওবন্দে স্বীকৃতি নিলে, দারুল উলুম দেওবন্দের যেভাবে স্বীকৃতি নিবে আমরাও সেই ভাবে স্বীকৃতি নিবো, যেহেতু আমরা দারুল উলুম দেওবন্দেরই শাখ (ডাল), আমরা একাএকি সনদের স্বীকৃতি দিতে পারব না, পাকিস্তানের মুফতি তকী উসমানী সাহেবের সাথেও এই বিষয়ে আমি আলোচনা করেছি, তিনিও আমাকে  সনদের স্বীকৃতির বিপক্ষে অটল থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এবং সনদের স্বীকৃতির খারাপ দিকগুলো শুনিয়েছেন৷ যাই হোক এখন সনদের স্বীকৃতি নিয়ে অনেক কিছু হইলো, সব কথা আপনারা জানেন, হয়ত আপনারা আমার চেয়ে বেশি জানেন, আমি দেখলাম যে যাদের সাথে আমি বসে আছি, এরা সবাই স্বীকৃতির পক্ষে, আমি করি কি? আমি আবার তাদের সদর, বললাম যে ভাই, আপনারা সবাই আহলে ইলম, আপনারা দ্বীনি মাদ্রাসার মুহাব্বত রাখেন, আমি কিচ্ছু বুঝিনা, আপনারা যা ফয়সালা করবেন, আমি দস্তখত করে দিবো, আমি কিছু বুঝি না, তবে আমার এই গুলা সরহে সদর হয় না, আমার ক্লিয়ার হচ্ছে না যে, আমরা দারুল দেওবন্দ এর উসুল থেকে সরে পরতেছি কি না? এভাবে চলতে চলতে সনদের স্বীকৃতি নেয়ার কাছাকাছি চলে গেল, এখন গন্ডগল বেঝে গেল, কেউ বলে এই সরকারের থেকে নেবো না, কেউ বলে দেওবন্দে যখন নেয় নাই আমরাও নিব না, এভাবেই চলতে থাকলো, হঠাৎ কথা উঠল, বর্তমান সরকারে উসুলে হাশতে গানার ওপর সনদের স্বীকৃতি দিবে, সরকার আমাদের ওলামায়ে কেরামকে ডেকে বললেন, আপনারা যেভাবে বলেন সেভাবে স্বীকৃতি দেয়া হবে, তো আমাদের ওলামায়ে কেরাম বলেছেন উসূলে হাসতে গানার উপর যদি স্বীকৃতি দেন তাহলে আমরা নিব, সরকারও নাকি বলছে যে, আমরা উসুলে হাশতে গানার উপরই স্বীকৃতি দিবো, আপনারা আসেন, কিন্তু আসা-যাওয়া হচ্ছে না কেন তা জানি না আমি, কেননা ঐ দিন হইতে আমি বাহির হইয়া গেছি, কেননা উসুলে হাশতে গানা তো আর থাকবে না, হযরত কাসেম নানুতুবীর উসুলে হাশতে গানা, মানে আটটি ধারার এক ধারা আছে “حکمراں جماعت کے ساتھ ان مدارس کا ضابطہ نہ رکھا جائے” সরকার বা সরকারের মদদদারী যারা আছে তাদের সাথে যেন কওমি মাদ্রাসার সম্পর্ক না থাকে, লেয়াজু না থাকে, এখন যদি সনদের স্বীকৃতি নেই তাহলে সরকারের সাথে আমাদের সম্পর্ক হয়ে গেল তো, উসুলে হাশতে গানা কোথায় রইল? হ্যা, বলতে পারেন উসুলে হাফতে গানার উপরে স্বীকৃতি নেয়া হবে, কি হচ্ছে না হচ্ছে ভাই জানিনা, আল্লাহ বেহতর জানে, তবে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করি, আল্লাহ! তুমি যদি পছন্দ কর আমাদের কওমি মাদ্রাসার ওলামা ত্বলাবাদের জন্য স্বীকৃতি নেয়া, তুমি ব্যবস্থা করে দাও, আর যদি তুমি নাপছন্দ করো, তাহলে হেকমতের সাথে, তুমি حکیم তুমি حاکم، আমাদেরকে তোমার হিকমতের সাথে ছহি পথে পরিচালনা করো, এখন এই দোয়াটা আমি করতেছি, সনদের পক্ষেও না, বিরুদ্ধেও না, বিরুদ্ধে না এই জন্য আমাদের ওলামায়ে কেরাম চাচ্ছে, পক্ষে না এজন্য দারুল উলুম দেওবন্দের উসুলে হাশতে গানার বিপক্ষে যাচ্ছে, তারপরে আর কিচ্ছু বুঝিনা, যার মনে চায় গালি দাও, যার মনে চায় তারিফ করো, একটা কথা শুনছি, প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছিলেন, সনদের স্বীকৃতি আমি বাধ্যতামূলক করব না, যার মনে চায় স্বীকৃতি নিবে, যার মনে চায় স্বীকৃতি নিবে না, এই কথাটা শুনেছি, সত্য কিনা জানিনা, ভেতরে ভেতরে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি, ইনশাআল্লাহ! কিছু মাদ্রাসা আমরা স্বীকৃতি ছাড়া থাকতে পারবো, আর আমি তো ভাই ছোট মানুষ, আমার মারকায কে তো স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো প্রশ্নই নাই, স্বীকৃতি নিবে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত, আমার মারকায তো তাখাসসুসাতের, দাওরায়ে হাদিস আমার উদ্দেশ্য নয়, প্রয়োজনে দাওরায়ে হাদিস বন্ধ করে দিয়ে তাখাসসুসাত রাখবো, তবুও স্বীকৃতি নেব না, বাহরেহাল আমার হায়াতে আমি স্বীকৃতি নিয়ে মরতে চাই না, আমার মুরুব্বীরা আমাকে যেভাবে আমানত দিয়ে গেছেন, এই আমানত নিয়ে আমি দুনিয়া থেকে যেতে চাই, আর আমার সাথে যারা যেতে চান, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকেও তৌফিক দান করুন”৷

হযরত রহঃ এর ইন্তেকালের পর আবার সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নের কথা উঠলো৷ যেহেতু হযরত রহঃ দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, আমি আমার বর্তমান শাইখ ও মুরুব্বী শাহ মুফতি সুহাইল দাঃ বাঃ কে সনদের স্বীকৃতির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম৷ হযরত দাঃ বাঃ ফকিহুল মিল্লাত এর আদর্শ ও চেতনার ওপর পরিপূর্ণ  রুপে আছেন বলে জানালেন এবং শাহ ফকিহুল মিল্লাত রহঃ এর দেওবন্দ ও হরদুঈ সফরে হযরত দাঃ বাঃ সাথেই ছিলেন বলে অবগত করলেন৷ এতগুলো কথা আপনাদের জানানোর উদ্দেশ্যে হলো, দারুল উলুম দেওবন্দ যদি সত্যিই বাংলাদেশের সরকারি স্বীকৃতির পক্ষে থাকতো তাহলে সায়্যিদ আসআদ মাদানী রহঃ কিভাবে বললেন যে, এটি দারুল উলুম দেওবন্দের ওসুলের খিলাফ৷ শাহ আবরারুল হক রহঃ কেন বললেন, যদি বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম সরকারি স্বীকৃতি গ্রহণ করে তাহলে বাংলাদেশে দ্বীনি মাদারিস থাকবেনা৷ সায়্যিদ আসআদ মাদানী আবারও বললেন, ভারত সরকার আমাকে সরকারি স্বীকৃতি দিতে চায়, আমি নেইনি৷ শাইখাইন এর অবদানে ভারত পাকিস্থানের জমহুর উলামাদের কারো কারো সাথে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে, তাদের দু একজনের কাছে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দারুল উলুম দেওবন্দ কি ভারত সরকারের স্বীকৃতি নিয়েছে? উত্তরে বললেন, নেয়নি৷ সাথে সাথে বললেন দু-একটি মাদ্রাসা নিয়ে ছিল এখন তারা বহুৎ পেরেশানিতে আছে৷ দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান মুফতি আল্লামা হাবিবুর রহমান খয়রাবাদী দাঃ বাঃ বলেন, উসুলে হাসতে গানা মানতে গেলে সনদের সরকারি স্বীকৃতির প্রশ্নই আসে না৷ এজন্য আমি শুরুতে বলেছিলাম বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ওলামায়ে কেরাম ঠিক করেছে না ভুল করেছে সেটি আমার জানার প্রয়োজন নেই৷ ওলামায়ে কেরামের হক কাজের সমর্থন অবশ্যই করতে হবে৷ কিন্তু আদর্শ গ্রহণ করতে পারব না, আমি সর্বোচ্চ ওলামায়ে কেরামের বিরোধী নই, তবে দেওবন্দী আদর্শবহির্ভূত কোন আদর্শের পক্ষেও নই৷ শাইখুুুনা শাহ ফকিহুল মিল্লাত রহঃ যখন আমাদের তৎকালীন বিশ্বের সর্বোচ্চ সনদ প্রদান করেন, তখন শর্ত দিয়েছিলেন, তার আদর্শ ও চেতনার উপর আজীবন থাকতে হবে, নইলে সনদ বাতিল৷ এজন্য বুঝি আর না বুঝি আমি হযরতের আদর্শের উপর আছি৷ হযরত রহঃ বলতেন, মহিলা মাদ্রাসা নাজায়েজ, মাসতুরাত জামাত নাজায়েজ, ডিজিটাল সহ সকল প্রকার ফটো ভিডিও হারাম৷ ব্যাস দুনিয়া যেদিকে যায় যাবে, আমি হযরতের কথার উপর আছি৷ আলহামদুলিল্লাহ, আমার বর্তমান মুরুব্বী ও শাইখ রাহবারে তরিকত মুফতি সুহাইল দাঃ বাঃ এর আদর্শ ও চেতনা শাইখ রহঃ এর আদর্শ চেতনায় হুবহু মিল রয়েছে৷ তাই আপনি আমাকে গালি দিলেও কিছু না, প্রশংসা করলেও কিছু না, শাইখাইন এর আদর্শ ও চেতনার ওপর আলহামদুলিল্লাহ আছি, আমরন থাকবো ইনশাআল্লাহ৷  বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ওলামায়ে কেরাম যেহেতু সনদের সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে নিয়েছেন, সেহেতু এখন আর কিছু করার নেই৷ দেখতে হবে ভবিষ্যতে কি হয়? যদি ভালো তো ভালো, নইলে দ্বীনি মাদ্রাসাগুলো আলাদা হয়ে দেওবন্দীয়্যাতকে সংরক্ষিত করতে হবে৷ আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে এই আদর্শের উপর থাকার তৌফিক দান করুন, আমীন৷

Loading