২০১৫ সাল। আমাদের সাথে আফগানিস্তানের কিছু সাথীও দাওরায়ে হাদীস পড়েন। দারুল উলূম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ. বুখারী শরীফের ক্লাস করাতে এলেন। হাদীসের মসনদে বসেই তিনি আমাদের বললেন, “তোমাদের আফগানিস্তানের এক সাথীর পিতা জিহাদের ময়দানে আমেরিকানদের আক্রমণে শহীদ হয়েছেন। তাঁর ২৮ জন ছেলে। কতককে নিয়ে তিনি সশস্ত্র সংগ্রাম করছেন, আর কয়েকজনকে পড়াশোনার জন্য দারুল উলূম দেওবন্দ পাঠিয়েছেন। সবাই এই শহীদের উদ্যেশ্যে সূরা ফাতিহা ও সূরা ইখলাস পড়ে ঈসালে সওয়াব করো।” ময়দানে যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদরত আছেন, তারা এখনও দারুল উলূম দেওবন্দকেই নিজেদের কেন্দ্র মনে করেন। তাই তো আফগানযোদ্ধারা সার্বিক বিষয়ে বাহরুল উলূম মাওলানা নেয়ামতুল আযমী হাফি. এবং মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী হাফি.-এর মতো যুগের ইমামতুল্য ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করেন, আপন সন্তানদের নির্দ্বিধায় দেওবন্দ পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে শতশত ছাত্ররা দেশে গিয়ে কেউ হাদীসের খেদমতে মত্ত হয়ে মুজাহিদ তৈরি করে, কেউবা আবার রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেওবন্দের সাথে আফগানদের একপ্রকার রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। কিছুদিন আগেও একজন আলেম সফরে এসে বললেন, ‘দেওবন্দ এলে আমরা হারানো চেতনা খুঁজে পাই’। তদ্রুপ কাশ্মীরিরাও দারুল উলূম দেওবন্দের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতি বছর অংসখ্য কাশ্মীরী ভাই দ্বীন শেখার জন্য এখানে আসে। দেওবন্দে এক কাশ্মীরীর সাথে পুরো বছর থেকেছি, খেয়েছি। ছাত্রাবাসের একই রুমে আমরা ঘুমাতাম। তার কাছ থেকে নিজ কানে শুনেছি, কাশ্মীরে যারা আন্দোলন ও সংগ্রাম করে যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই দেওবন্দী। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, উম্মাহর এই ক্রান্তিলগ্নেও দেখলাম মুষ্টিমেয় ‘ফেবু মগাহিদ’ বরাবরের মতো দারুল উলূম দেওবন্দ নিয়ে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। জন্মপরিচয়হীন ফেক আইডিধারীও মিথ্যাচার করে বলছে, দেওবন্দ নাকি হিন্দুস্তানের মুসলিমদের হিজড়া বানাতে বিশেষ অবদান রাখছে! দুই পয়সার গানের শিল্পীও দেওবন্দের হযরতগণকে দুনিয়ালোভী-পেটাপূজারী আখ্যা দেয়ার স্পর্ধা দেখায়! এই মগাদের হয়তো জানাই নেই, দেওবন্দের মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরীরা তাকওয়ার ওপর আমল করতে গিয়ে ১৮ বছর যাবৎ মাদ্রাসা থেকে একটাকাও বেতন গ্রহণ করেন না। উল্টো প্রতিদিন রিকশা ভাড়া দিয়ে এসে বুখারীর ক্লাস করান।
.
ভারতীয় সংবিধান থেকে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর হিন্দুস্তানের অন্য কোথাও প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো হয়নি, কিন্তু দেওবন্দ নগরীতে ঠিকই বৃদ্ধি করা হয়েছে। অলিতে-গলিতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এমন মুহূর্তে কাশ্মীর ইস্যুতে সাংবাদিকরা দারুল উলূম দেওবন্দের অবস্থান জানতে চাইলে মাওলানা আব্দুল খালেক মাদ্রাসী সাহেব হাফি. এই বলে এড়িয়ে যান যে, ‘এটা রাজনৈতিক ইস্যু। আর দারুল উলূম দেওবন্দ হচ্ছে একটি ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দারুল উলূম দেওবন্দ এসব বিষয়ে নীরব থাকে’। দারুল উলূমের প্রিন্সিপাল মুফতী আবুল কাসেম নূমানী দা.বা. হয়তো হজ্বে আছেন। দায়িত্বে রয়েছেন ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল খালেক মাদরাসী হাফি.। হযরতকে অনেকে ‘খতীবে হিন্দুস্তান’ বলে থাকেন। অগ্নিঝড়া জিহাদী বক্তব্যের কারণে হিন্দুত্ববাদীরাতাঁকে টার্গেটে পরিণত করেছিল। তাঁর বহির্বিশ্বের সফরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ শুনেছি। রাসূলপ্রেমিক এই আল্লাহর বান্দার ‘শামায়িলে তিরমিযী’র ক্লাসে বসলে বোঝা যায়, ইসরায়েল-আমেরিকার কারসাজি সম্পর্কে তিনি কতটা সচেতন। ছাত্রদেরও এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রদের বলে থাকেন, ‘উপমহাদেশে খুব কম সংখ্যকই আল্লাহর অলী আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যান্য সুন্নতের তুলনায় জিহাদ সম্পর্কে যাদের অন্তরে কম আগ্রহ থাকে, তারা কী করে আল্লাহর অলী হতে পারে?
তিনিও যখন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মিডিয়াতে আসেন, তখন বিভিন্ন অজুহাতে মন্তব্য করতে বিরত থাকেন। দেওবন্দের প্রকৃত হিতাকাঙ্ক্ষীরা এসব কৌশল বুঝে, না বুঝলে আসল বিষয়টি জানার চেষ্টা করে। হিন্দুত্ববাদীরাযেখানে কাশ্মীর ইস্যুতে দারুল উলূমকে সন্দেহের নজরে দেখছে, সেখানে অন্ধ-বিদ্বেষী তথাকথিত মানহাজীরা দেওবন্দ সম্পর্কে পাগলের মতো উল্টাপাল্টা বকে যাচ্ছে।
.
কথিত মানহাজীরা অনলাইনে এসে বাংলাদেশ দারুল হারব, এ দেশের সরকার তাগুত, পুলিশ-আর্মিতে চাকরি করা বৈধ নয়, সরকারের দেয়া ভিসা আমান (নিরাপত্তা) নয় বলে চিল্লাচিল্লি করে। কিন্তু রাজপথে মিডিয়ার সামনে এসে তাদেরকে এসব ঘোষণা দিতে বলা হলে বাটি চালান দিয়েও এই ভীরুদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাদের আরও মারাত্মক মুনাফিকির দিক রয়েছে। তারা নিজেদের কাপুরুষতাকেও জিহাদের অংশ বানিয়ে ফেলে। এমনই এক জন্মপরিচয়হীন ফেক আইডিধারীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সাহস থাকলে আসল পরিচয়ে সামনে আসেন না কেন? তখন সে বলেছিল, “এটা হলো যুদ্ধের ময়দান। আর রাসূল সা. বলেছেন, ‘যুদ্ধ মানেই কৌশল অবলম্বন করা’। হাদীসটি ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের ময়দান সম্পর্কে। সেই হাদীসটি জুকারবার্গের ফেসবুকে এনে লাগিয়ে দিয়েছে সে! তাই তো এদেরকে ফেবু মগাহিদ বলা হয়। কেউ প্রচলিত রাজনীতিকে জিহাদের সাথে তুলনা করে, আবার কেউ নির্বাচনকে জিহাদের অংশ বলে ঘোষণা দেয়, কেউবা আবার নফসের জিহাদকে বড় জিহাদ বলে আসল জিহাদ এড়িয়ে যায়, আর এরা কিবোর্ডে গুঁতাগুঁতি করাকে জিহাদের অংশ মনে করে। মূলত জিহাদের বিধান বিকৃতির ক্ষেত্রে এরা কেউ কারোর থেকে পিছিয়ে নেই।
পক্ষান্তরে দারুল উলূম দেওবন্দ শুধু সশস্ত্র সংগ্রামকেই জিহাদ মনে করে। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে হয়তো কিছু বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন না। এই কোশল আকাবিররাও অবলম্বন করে গেছেন। প্রতিষ্ঠানের ওপর যেন আঘাত না আসে শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ. ঐতিহাসিক রেশমি রুমাল আন্দোলনটি প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে পরিচালনা করেছেন। একান্ত প্রয়োজনে দারুল উলূমের ভেতর মিটিং করলে উর্দু-হিন্দেতে কথা বলতেন না; বরং গোয়েন্দারা যাতে না বুঝতে পারে আরবীভাষায় কথা বলতেন। এভাবেই তাঁরা নিজের মাথা দিয়ে প্রতিষ্ঠান আগলে রেখেছেন। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু মুজাহিদ নয়, একাধারে আলেম, রাজনীতিবিদ এবং দ্বীনের দায়ী তৈরির ফ্যাক্টরি। তাই এগুলোকে বন্ধ হতে দেয়া যাবে না। উপরন্তু হিন্দুস্তান একটি অমুসলিম রাষ্ট্র। এর একটি রাজ্যই বাংলাদেশ থেকে আয়তনে বড়, জনসংখ্যায় বেশি। ভারতের সব মুসলমানরা আবার দেওবন্দী ঘরানারও নয়; মাত্র এক তৃতীয়াংশ মুসলিম হলো দেওবন্দী মতাদর্শের। বিশাল বড় এই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমনও মুসলমান বসবাস করে, যারা কালিমাটা বলতে জানে না, আমাদের নবীজির নাম জানে না, আযান-নামায বলতে কিছু বুঝে না। কুরআন-হাদীসে কিছু বেদুঈন-গ্রাম্য ব্যক্তির আলোচনা আসে। বর্তমান বিশ্বের অন্য কোথাও এমন গ্রাম্য ব্যক্তিদের উপস্থিতি আছে কিনা জানি না, তবে হিন্দুস্তানে বেদুঈনদের দেখা ঠিকই মেলে। তাবলীগী জামাতের পাশাপাশি দারুল উলূম দেওবন্দও তাদের নিয়ে ফিকির করেন। নরেন্দ্র মোদীর আগ্রাসনে বর্তমান ভারতের নাজুক অবস্থার কথা কারও অজানা নয়। এমন হাজারও প্রতিকূলতা সত্ত্বে দারুল উলূম দেওবন্দ এখনও সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন আছে। দেড়শো বছরের ইতিহাসে সরকার থেকে এক টাকাও দারুল উলূম গ্রহণ করেনি। বিদেশীদের অনুদান পর্যন্ত গ্রহণ করে না, শুধু হিন্দুস্তানের খেটে-খাওয়া মানুষদের স্বেচ্ছায় দানের মাধ্যমে দেড় শতাব্দী যাবৎ প্রতিষ্ঠানটি চলছে।
.
সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদও করছে। কখনও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, আবার কখনও সাংগঠনিক পন্থায়। হযরতুল উস্তায মাওলানা আরশাদ মাদানী হাফি. ছাত্রদের একদিন বলেছিলেন, ‘বিক্ষোভ ও মিছিলে তোমাদের যাওয়ার দরকার নেই। জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ এগুলো দেখছে। আমরাই আন্দোলন করবো’। তারপরও কিছু ছাত্র ঠিকই অংশগ্রহণ করতো। কারণ ওইটা নিছক প্রাতিষ্ঠানিক কানুন ছিল; একেবারে নিষেধাজ্ঞা নয়। তো মাওলানা আরশাদ মাদানী হাফি. যে সমস্ত আন্দোলন করে থাকেন, সেগুলোও দারুল উলূমের অংশ। কারণ তিনিও দারুল উলূমের একজন সিনিয়র উস্তাদ। হিন্দুস্তানের সবচে’ ক্ষমতাধর সংগঠন হলো ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’। এটাতে শিয়া, জামাতে ইসলামী, আহলে হাদীস, বেরলভীসহ মোটামুটি সব মাসলাকের মুসলিমই শামিল আছে। দারুল উলূম দেওবন্দ আগেই জানিয়ে রেখেছে যে, মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড যে সব সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি গ্রহণ করবে, দারুল উলূম সবসময় সেগুলোর সাথে একমত থাকবে। সুতরাং পার্সোনাল ল বোর্ড কোনো ব্যাপারে আন্দোলন করলে সেটার মধ্যে দেওবন্দও শামিল আছে। আলাদা দারুল উলূমের ব্যানারে আন্দোলন করতে হবে-এমন কোনো কথা নেই। কিছু বিষয়ে দারুল উলূমের তরফ থেকেও বিবৃতি আসে। যেমন-তিল তালাক বিলের বিরোধিতা দারুল উলূম বারংবার করেছে।
.
ফালতু জযবাতিরা শুধু দারুল উলূম দেওবন্দ নিয়েই বিদ্বেষ ছড়ায় না, বরং তাদের টার্গেট হলো প্রতিটি কওমী মাদ্রাসা। কখনও মাদানীনগর, বায়তুন নূর, ফরিদাবাদ, আবার কখনও হাটহাজারী, রহমানিয়া, দারুল উলূম করাচি সম্পর্কে ঘৃণার উদ্গিরণ করে। তারা তো মুফতী তাকী উসমানী হাফি.-কেও তাগুতের গোলাম বলতে দ্বিধাবোধ করে না। মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব দা.বা.-এর কিছু অবস্থান তাদের পক্ষে গিয়েছিল বিধায় তারা তাঁকে খুব প্রমোট করতো। মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব যখন তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলতে শুরু করলেন, তখন তিনি হয়ে গেলেন সরকারি মৌলভী। তারা এখন মারকাযুদ দাওয়াকে হায়েযের মারকায(নারীদের মাসিকবিষয়ক কেন্দ্র) আর ইরজার সেন্টার বলে তাচ্ছিল্য করে। শায়েখ জুনাইদ বাবুনগরী হাফি. এতদিন ছিলেন তাগুতবিরোধী সিপাহলার। একটি বক্তব্যে শেখ হাসিনাকে মুসলমান এবং হাটহাজারীর ছাত্রদেরকে এসব তাকফিরী জামাতের বিভ্রান্তি সম্পর্কে সতর্ক করার কারণে তিনি এখন তাদের চোখের কাটা হয়ে গেলেন। প্রতিটি বাতিল ফিরকার কাজ হলো, নির্ভরযোগ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আস্থাহীন করে তোলা আর উম্মাহর গ্রহণযোগ্য আলেমদের নিয়ে বিষোদগার করা। কথিত মানহাজীদের মিশনও এটাই। তারা নামধারী আহলে হাদীসদের মতো সুবিধাবাদীও বটে। কম্বল মুজাহিদ, ফেবু মগাহিদ, কথিত মানহাজী, তাকফীরি জামাত, কিবোর্ড মুজাহিদ, পাতলা জযবাতি যা-ই বলা হোক কেন তাদের ওপর নির্দিষ্ট কোনো নাম ফিটিং করা মুশকিল। যেমনভাবে নব্য সালাফী, কথিত আহলে হাদীস, লা মাযহাবী, মাদখালীদের ওপর কোনো নাম সেটেল করা দুষ্কর। কারণ যে দিকে ঝোল পড়ে, সে দিকেই তারা লুকমা ধরে। দিন শেষে মানহাজী আর মাদখালীর মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। উভয়টাই আদর্শহীন ফিরকা।